Ticker

6/recent/ticker-posts

প্লেটোর রিপাবলিক - সরদার ফজলুল করিম

প্লেটোর রিপাবলিক - সরদার ফজলুল করিম

প্লেটোর রিপাবলিক - সরদার ফজলুল করিম
পশ্চিমের লোকেরা বলে, তাদের সমস্ত জ্ঞানভান্ডারের আঁতুড়ঘর ছিল প্রাচীন গ্রিস। পুবের লোকেরাও স্বীকার না করে পারে না, তাদের মননেও গ্রিক মনীষার প্রভাব সুগভীর। পুব-পশ্চিম উভয়ের চিন্তাজগৎকে প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে প্রভাবিত করে চলেছে যে গ্রিক দর্শন, তার প্রায় অর্ধেকটা রূপায়িত হয়েছে প্লেটোর হাতে। প্লেটো পৃথিবীর প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থকার, যাঁর প্রায় ৩৫টি গ্রন্থ আমাদের কাল পর্যন্ত পৌঁছেছে। সেগুলো একেকটা মণিরত্ন; সেই রত্নভান্ডারের সবচেয়ে উজ্জ্বল রত্নটির নাম দ্য রিপাবলিক।
প্লেটোর সব লেখাই সংলাপ। রিপাবলিক তাঁর দ্বিতীয় বৃহত্তম সংলাপ, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮০-৩৮২ সালের দিকে লেখা। সক্রেটিস নামে এক ব্যক্তির মুখে বর্ণিত এ সংলাপের প্রধান চরিত্র প্লেটোর গুরু সেই সক্রেটিসই বটেন, যিনি এথেন্সের যুবসমাজকে বিপথগামী করার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে হ্যামলক পান করেছিলেন। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে দ্য রিপাবলিক প্লেটোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ। এ গ্রন্থকে রাসেল মোটা দাগে ভাগ করেন তিনটি অংশে। প্রথম অংশে আছে একটি আইডিয়াল কমনওয়েলথ বা আদর্শ রাষ্ট্র গঠন সম্পর্কে আলোচনা। সেসব আলোচনার অন্যতম উপসংহার: শাসকেরা অবশ্যই হবেন দার্শনিক। দ্বিতীয় অংশের আলোচনার বিষয় দার্শনিক কে? কীভাবে একজন মানুষ দার্শনিক হয়? শুভ, ন্যায়পরায়ণতা, জ্ঞান, ধারণা বা অভিমত, সত্তা, অবভাস ইত্যাদি বিষয় অংশের আলোচ্য। তৃতীয় অংশে আছে বিভিন্ন নগররাষ্ট্রে প্রচলিত শাসনতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা ও সেগুলোর দোষগুণ বিচার।
রিপাবলিকে প্লেটোনিক সক্রেটিসের সংলাপ চলে এথেন্স ও এথেন্সের বাইরের কজন ব্যক্তির সঙ্গে। আদর্শিক ও বাস্তবিক পরিপ্রেক্ষিতে জাস্টিস বা ন্যায়ের স্বরূপ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষে সক্রেটিসের বয়ানে প্লেটো এমন এক ন্যায়পর রাষ্ট্রের কল্পনা হাজির করেন, যার শাসকেরা হবেন দার্শনিক। প্লেটোর সক্রেটিস বলেন, ‘যতক্ষণ না দার্শনিকেরা রাজা হচ্ছেন বা জগতের রাজা ও রাজপুত্রগণ দার্শনিক চেতনা ও দার্শনিক শক্তির অধিকারী হচ্ছেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না রাজনৈতিক মহত্ত্ব ও প্রজ্ঞার মিলন ঘটছে আর তাদের বাধাদানকারী সাধারণ প্রকৃতির লোকেরা যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত নগররাষ্ট্রগুলো অমঙ্গলের হাত থেকে রেহাই পাবে না, মানবজাতিও মুক্তি পাবে না বলে আমার বিশ্বাস।’
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকেরা বিভক্ত থাকবে তিনটি শ্রেণীতে: জনসাধারণ, সৈন্যবাহিনী ও অভিভাবকমণ্ডলী। এমন বিশ্বাস সৃষ্টি করা হবে যে ঈশ্বর তিন প্রকারের মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে যারা সর্বোত্তম তারা সোনার তৈরি, দ্বিতীয় সারির লোকেরা রুপার, আর সাধারণ জনতা পিতল ও লোহার তৈরি। সোনার তৈরি লোকেরা হবে অভিভাবক, রুপার তৈরি লোকেরা হবে সৈনিক আর অবশিষ্টদের করতে হবে কায়িক পরিশ্রম। জাস্টিস বা ন্যায়পরায়ণতা বলতে বোঝাবে প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ নিজ কাজ সম্পাদন করা। কার কী কাজ বা পেশা, তা নির্ধারণ করে দেবে সরকার।
রিপাবলিকে একটি রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থার প্রায় সব ক্ষেত্র নিয়ে প্লেটোর প্রস্তাবনা আছে: আদর্শ রাষ্ট্রে শিক্ষার উদ্দেশ্য, পদ্ধতি ও স্বরূপ কী হবে, কেমন হবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। প্রথম ভাববাদী দার্শনিক হিসেবে প্লেটোর পরিচয় যে কারণে, সেই ভাবতত্ত্ব বা থিওরি অব আইডিয়াস তিনি হাজির করেছেন এই গ্রন্থে বিশদভাবে। রাজনীতি ও জীবনকে দর্শনের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা ছাড়াও দ্য রিপাবলিক গ্রন্থে আছে ধর্ম, অমরত্ব, বিজ্ঞান, নাটক, কাব্যকলা ইত্যাদি নিয়ে প্লেটোর ভাবনা। এই গ্রন্থে তিনি যেসব ভাবনা ও জিজ্ঞাসা উপস্থাপন করেছেন, সেগুলো নিয়ে আলোচনা চলেছে পরবর্তী দুই হাজার বছর ধরে।
প্লেটোর রিপাবলিক আদিতম ইউটোপিয়া বা কল্পরাষ্ট্র, সিসেরোর দে রিপুবলিকা, সেন্ট অগাস্টিনের সিটি অব গড, টমাস মুরের ইউটোপিয়ার আদি মডেল। খ্রিষ্টীয় গির্জার আদিকালে চর্চিত ধর্মতত্ত্বে প্লেটোর বর্ণিত ‘অন্য জীবনে’র প্রভাব প্রবল। কবিদের মধ্যেও প্লেটোর প্রভাব লক্ষণীয়: দান্তে ও কোলরিজ দুই বড় দৃষ্টান্ত। দ্য রিপাবলিককে শিক্ষাবিষয়ক প্রথম সন্দর্ভ হিসেবেও বর্ণনা করা হয়, যার গভীর প্রভাব লক্ষ করা গেছে জন মিল্টন, জন লক, রুশো, গ্যেটে প্রমুখের ওপর।
দ্য রিপাবলিক অনূদিত হয়েছে পৃথিবীর প্রায় সব শিক্ষিত জাতির ভাষায়। ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন অন্তত অর্ধশতজন। বেনজামিন জোয়েটের ইংরেজি অনুবাদ সর্বাধিক আলোচিত; এটি থেকেই বাংলায় দ্য রিপাবলিক অনুবাদ করেছেন সরদার ফজলুল করিম প্লেটোর রিপাবলিক নামে। এর প্রথম প্রকাশক বাংলা একাডেমী, পরে তা প্রকাশ করে মাওলা ব্রাদার্স। এখন বাজারে মাওলা ব্রাদার্সের সংস্করণটিই পাওয়া যায়।