Ticker

6/recent/ticker-posts

যুক্তি ও কল্পনাশক্তি - গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় 

জন্মশতবর্ষ স্মারক বক্তৃতা ২০১৮ 

যুক্তি ও কল্পনাশক্তি


নমস্কার। আজকের এই সভায় আমার পক্ষে কিছু বলা অন্যায়, কেননা, আমি সত্যিই—রামকৃষ্ণ ভট্টাচাৰ্য যেটা বললেন- 'আত্মবঞ্চিত'। সেদিক থেকে বলতে পারব যে অনিল আচার্য আমাকে একটু বিব্রত করেছেন। মুখে বলেছিলেন বটে যে এই সভায় বলতে হবে, কিন্তু শুধুই তো মুখে বলেছিলেন—সাতাত্তর চলছে, সব কথা মনে থাকে না তো—একটা ইমেল করলে হয়তো ঠিকমতো ভাবে এই আত্মবঞ্চনার হাত থেকে নিজেকে একটুখানি রক্ষা করতে পারতাম। কিন্তু সেই সময়টুকু কল্যাণীয় অনিল আমাকে দেননি; এদিকে আমার ‘না’-ও মানলেন না। কাজেই এই ভাষণ দিতে আমি অযোগ্য—এটা জেনে আমার কথা শুনবেন। এবং আর-একটা কথা বলছি: কোনও সময় হয়তো বলেছিলাম যে 'দর্শন ও সাহিত্য’ থাকবে আমার বিষয়। কিন্তু আমার মনে বিষয়টা থেকে গেছে—‘যুক্তি ও কল্পনাশক্তি'। দুটো কিন্তু এক নয়।

'দর্শন ও সাহিত্য' সম্পর্কে বলবার আমার কোনও অধিকারই নেই। আমি ইংলিশ অনার্সের ছাত্রী; দার্শনিক নই, কবিতাও লিখি না। কবিতা ভালোভাবে পড়তে শিখিয়েছেন শিক্ষকরা এবং কবিতা মাইনে নিয়ে পড়াই। সুতরাং আমি ‘দর্শন ও সাহিত্য' সম্বন্ধে কী বলব? আমার মনের মধ্যে যেটা ছিল সেটা হচ্ছে: 'যুক্তি ও কল্পনাশক্তি'। কাজেই, মনে কিছু করবেন না, ওই সম্বন্ধেই বলব। এমন দিনে এমন বক্তৃতা দেওয়া উচিত, যা দেবীপ্রসাদের কাজকে আপন পাণ্ডিত্য ও সহমর্মের আলোয় আপনাদের কাছে তুলে ধরতে পারে। সে কাজ আমি করতে পারব না—প্রথম থেকেই বলছি। 

রামকৃষ্ণ (ভট্টাচার্য) আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আত্মবঞ্চনা' হল কী করে? কটা কথা মনে রাখবেন- যখন আমরা কলেজে পড়ছি, তখন আমাদের কাছে ইংরেজি ছিল একটা ‘বিষয়’, একটা ‘ডিপার্টমেন্ট”। আমার পাশ সাবজেক্ট ছিল ইকনমিক্স আর হিস্ট্রি। ফিলসফি একটা অন্য ডিপার্টমেন্ট। আমি উনিশ বছর বয়সে দেশ ছেড়েছি। তখন যে খুব ফিলসফি পড়তাম, তা নয়। সেই সময় পারিবারিক সম্পর্ক ছিল জ্ঞান মজুমদার ও সমর সেনের সঙ্গে। সেই সূত্রে কৈশোরে, যৌবনে এবং মধ্যবয়সে বামপন্থার সঙ্গে পরিচয়ে পশ্চিমবঙ্গ আমাকে চিন্তায় সাহায্য করেছে। জ্ঞান মজুমদার আমার পনেরো বছর বয়সে আমার হাতে ক্যাপিটাল প্রথম খণ্ড (ইংরেজিতে)" তুলে দিয়ে বলেছিলেন, পড়িস—এটা পড়িস। বুদ্ধিমতী ছিলাম, কাজেই পড়তে শুরু করেছিলাম ঠিকই। শেষ ও করেছিলাম। 

সমর সেনের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা আমি লিখেছি। সত্তরের দশকে আমার তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক হয়। আগে ছিলেন আমার ‘খোকামামা’! তুই-তোকারি ছিল। যখন সত্তরের দশকে কথা বলতে শুরু করলাম, তখন সম্বোধন শুধু ‘গায়ত্রী’ আর ‘আপনি’। অদ্ভুত ব্যাপার। এত সুন্দরভাবে সেটা হয়েছিল। 

যাই হোক, আমি উনিশ বছর বয়সে দেশ ছাড়লাম ৷ তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্রী। আমার অধ্যয়নের ভাষা : ইংরেজি, ফরাসি ও জর্মন। স্বভাবতই বামপন্থা সম্পর্কে পড়াশোনা হয়েছে ওই তিন ভাষায়। এটা কোনও দোষের নয়—এগুলি সবই কারোর না কারোর মাতৃভাষা। অনিলের আমন্ত্রণের পর যতটুকু পেরেছি দেবীপ্রসাদ পড়েছি। অভিভূত হয়েছি আবেগ, সততা, কর্মক্ষমতা ও নেতৃত্বের সমন্বয়ে। 

নিজের বক্তব্যের জন্য রেখেছি : 'যুক্তি কল্পনাশক্তি'। যেটা নিয়ে অন্তত অক্ষম সক্রিয়তা (যেটা বলবার চেষ্টা করেছি, সেটা হল unrestricted dialec- tics, ওটার বাংলা করার কোনও দরকার নেই) ক্লাসরুমে ও ক্লাসরুমের বাইরে চলেছে সারাজীবন। অন্তত অভিজ্ঞতার অভাব নেই। সংক্ষেপে আমার বক্তব্য এই যে কল্পনাশক্তির ব্যায়াম নিয়মমতো শেখানো হয় না বলে সাধারণ মানুষের মনে (আমি দেবীপ্রসাদের কথা বলছি না, তিনি অসাধারণ ছিলেন, এবং সমর সেনও) বামপন্থা এখন আত্মরক্ষা এবং স্বার্থাধিকারের পথ বৈ আর কিছু না। সারা জগতের শোষণ থামানোর যে-অদম্য ইচ্ছে সম্বন্ধে মার্কসসাহেব লিখেছিলেন, আজকের দুর্ধর্ষ পুঁজিবাদের সামনে সেই ইচ্ছের অঙ্কুর পোঁতা অসম্ভব। বাকি সময়টুকুতে এই ধারণাটাকেই ব্যাখ্যা করব। শেষে আপনারা প্রশ্ন ও মন্তব্য করে আমাকে তিরস্কার করবেন, সংশোধন করবেন অথবা সমর্থন করবেন। 

সমর সেন সমাজকল্যাণ করতে কবিতা লেখা ছেড়েছিলেন। আজ অনিলের কাছে গল্প শোনা গেল, দেবীবাবুকেও তিনি কবিতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ বিরত করেছিলেন। এটা তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু সারা বিশ্বের কল্যাণকল্পনা তিনি করতে পারতেন এ-আমার জানা। সুতরাং বৃহত্তর অর্থে, কাব্যশক্তি তিনি হারাননি। 'কবি' শব্দের প্রাচীন অর্থের অধিকার তিনি অর্জন করেছেন, প্রয়োগ করেছেন। দেবীপ্রসাদও সেই কল্পনার অধিকারী ছিলেন। এ-জিনিসটা দূর থেকে বোঝা যায় না। আমি কবি নই। তবে কবিতা কিছুটা পড়তে পারি, পড়াতে পারি, অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। মাইনেকরা শিক্ষক হিসেবে আমি আমার ছাত্রের ভৃত্য। কবিতা ও যুক্তির সম্পর্ক বুঝিয়ে আমি সেই ভূমিকায় কিছুক্ষণ আপনাদের সেবা করতে চাই। 

বিপ্লবের content সম্বন্ধ মার্কস বিশেষ কিছু লিখে যাননি। তাঁর আগ্রহ ছিল কনটেন্টবিহীন ভ্যালু-ফর্ম (value-form) নিয়ে, এবং যেহেতু শ্রমতত্ত্ব তিনি ভ্যালু-ফর্ম দিয়ে কষেছেন, তাঁর কাছ থেকে কনটেন্ট আশা করাও উচিত নয়। মার্কস লিখেছিলেন, Value form is contentless-inhaltlos | Inhalt fe con- tent, los অর্থাৎ less। আপনি দেখবেন সমস্ত ইংরেজি অনুবাদে লেখা রয়েছে— 'slight in content' | 

এই অনুবাদে তো মার্কসের আইডিয়াটাই নষ্ট হয়ে গেল। এই জিনিসগুলো আমায় দুঃখ দেয়। মার্কসের শুধুই একটি বিখ্যাত উদ্ধৃতিতে, তাঁর জার্নালিস্টিক লেখায়, আমরা বিপ্লবের কনটেন্ট-এর একটি উচ্ছ্বসিত বর্ণনা পাই: The Eighteenth Brumaire of Louis Bonaparter-এ মার্কস লিখেছেন, নতুন যুগের বিপ্লব তার ‘ভরাটি’ বা content খুঁজে পাবে ভবিষ্যতের কবিতায়— 'The revolution of the nineteenth cen- tury will look for its content in the poetry of the future'। অবশ্য বলা যেতে পারে যে এটাও উচ্ছ্বাস ! কবিতা এখানে রূপক অথবা অলংকার ধরে যে শেখা যায় সেটা ভুললে চলবে কেন! 

অলংকার থেকে শেখবার যে-একটা ধরন আছে, সেটাই তো আমরা শিখি ও শেখাই (আজ আর এই শিক্ষার চলন নেই। বৃহৎ ক্ষতি হয়েছে আমাদের)। মার্কসের প্রাতিষ্ঠানিক খেতাব ছিল গ্রিক-দর্শনে। উনি গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের কাজ আগাপাশতলা জানতেন। সেই কাজের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন দাস ক্যাপিটাল-এর প্রথম খণ্ডে। একথাও বলেছেন, যেহেতু অ্যারিস্টটলের যুগে পুঁজি তার স্বরূপ ধারণ করতে পারেনি, সেহেতু অ্যারিস্টটল ভ্যালু-ফর্ম চিন্তা করতে পারেননি। কাজেই ফর্ম-অনুযায়ী যে-বিপ্লব, অর্থাৎ উৎপাদনের উপকরণ অর্থাৎ means of production-এর মালিকানা হস্তগত করে পুঁজিকে সাম্যবাদীভাবে ব্যবহার করা—সেই প্রাঙ্গণে অ্যারিস্টটলের প্রবেশ নিষেধ (পরিণত মার্কসের বক্তব্য—‘পুঁজি ভালো, পুঁজিবাদ খারাপ’– অনেক উচ্ছ্বসিত রোমান্টিক অ্যান্টি-ক্যাপিটালিস্টই বুঝতে পারে না—যাই হোক, এটা আমার বক্তব্য নয়)। 

কিন্তু অ্যারিস্টটলের বিখ্যাত উক্তি—ইতিহাসের চাইতে কাব্য, historia-র চাইতে poiesis, জ্ঞানের শ্রেয়তর পথ”–মার্কসের সেটা জানা ছিল। অবশ্য এটা মনে রাখতে হবে অ্যারিস্টটলের যুগে poiesis বলতে ঠিক আক্ষরিকভাবে কবিতা ও কাব্য বোঝাত না। কিন্তু মার্কস jurisprudence-এর ছাত্র। তিনি এটা অবগত নাও থেকে থাকতে পারেন। আমাদের লক্ষ করা দরকার যে মার্কস এখানে কবিতা ও কাব্য বলতে যে কথাটি ব্যবহার করেছেন, সেটা সাধারণ জার্মান Dichtung নয়। আপনারা অনেকেই জানেন যে, সেই সময় Dichtung কথাটা—বিশেষ করে গ্যেটের [Goethe ] Dichtung und Wahrheit—কবিতা এবং সত্য, কবিতা এবং যুক্তি-অত্যন্ত ভারপ্রাপ্ত কথা হয়ে গেছে। সেটা ধরে আমরা আধুনিক যুগে আসতে পেরেছি। কিন্তু মার্কস সেই কথাটা ব্যবহার করেননি। মার্কস অ্যারিস্টটেলিয়ন কথাটা ব্যবহার করেছেন: poiesis। সেটি গ্রিক তদ্‌ভব। মার্কস কানে শুনতে পাচ্ছেন অ্যারিস্টটলের কণ্ঠ- historia-র চাইতে poiesis অনেক philosophoteron | এই philosophoteron-এর অনেকে ইংরেজি অনুবাদ করে more scientific—সেটা ঠিক নয়। Philosophia বা জ্ঞানকে ভালোবাসা। সেটাকে 'more scientific' বলে ইংরেজি করাটা ঠিক নয়। অ্যারিস্টটল লিখেছেন poiesis, historia-র চাইতে philosophoteron অর্থাৎ জানার আরও শ্রেয় পথ। 

আমি গ্রিক ও জর্মন খুব ভালো জানি না। ছাত্রাবস্থায় ভাষাশিক্ষার খুব সুবিধা ছিল না কলেজে। কিন্তু যেহেতু এ-দুটি অ্যারিস্টটল ও মার্কসের মাতৃভাষা, ধরবার চেষ্টা করি। জর্মন কোনোরকমভাবে Dichtung-এর মতো কথাটি মার্কসের জীবৎকালে গ্যেটের মাধ্যমে প্রচুর প্রাধান্য পেয়েছিল। গ্যেটের আত্মজীবনী Dichtung und Wahrheit, 'কাব্য ও সত্য’, আমাদের বর্তমান প্রসঙ্গ ‘কল্পনা ও যুক্তির একটি version। সুতরাং মার্কস বিশেষ আগ্রহে 'Poesie' কথাটার ব্যবহার করেছেন, এটা লক্ষণীয়। বিপ্লবের ভরাটির লক্ষ্য ভবিষ্যতের স্বাতন্ত্র্য। ইতিহাস তার তথ্যের নির্দেশে ভবিষ্যৎকে নির্ণয় করে এবং সেই অনুযায়ী এগোয়। কিন্তু ভবিষ্যৎ তো অজানা। সুতরাং অ্যারিস্টটলকে ব্যাখ্যার ছলে বলা যায়—কবিতা যেহেতু নির্ণয় করে না, রূপায়ণ করে, তাই রূপকের আক্ষরিক মানে যুগে যুগে স্বপরিবর্তিত হয়ে যুগোপযুক্ত আক্ষরিক সত্যকে প্রকট করে। এইটাই কি অ্যারিস্টটলের বক্তব্য ? হয়তো। এই ‘হয়তো'-র নির্দিষ্ট উত্তর বিপ্লবী কোনোদিন পাবে না। কেননা ভবিষ্যতের সত্য রূপকের মাধ্যমে 

যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়। এ-সত্যকে অস্বীকার করলে ইতিহাসের গতিকে অস্বীকার করা হয়। সহজেই বলা যেতে পারে, আহা, এটা বড়ো ইউটোপিয়ান। তা কিন্তু নয়, ইউটোপিয়ান মার্কসিজম বা ইউটোপিয়ান সোশালিজম অন্য জিনিস। উৎপাদন-প্রণালীর শুষ্ক আখ্যান দিয়ে ইতিহাসের গতিকে অনুধাবন করা—শুধু form, শুধু যুক্তি। ইতিহাসের ভরাটি হচ্ছে ভবিষ্যতের কবিতা, আর তার মাধ্যম রূপক। কাজেই কবিতা পড়তে শিখতে হয়। ব্যক্তিগত মৃত্যুর পর ভবিষ্যৎ—'দুর্গম পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি”–কবিতা শুনতে শিখতে হয়। নিজের জীবনের বর্গের মধ্যে কবিতা যিনি লেখেন, তাঁকে যুক্তিযুক্তভাবে স্বীকার করতে হয় যে, সেই সীমার মধ্যে কবিতা লেখা শেষ করা উচিত। কিন্তু পাঠক তাঁর কবিতা ছাড়ে না। ভবিষ্যতের ইঙ্গিত পায়। এই তো সমস্যার বৃত্তান্ত। 

দেবীপ্রসাদ দর্শনে নির্বাচন করলেন সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত দার্শনিক চার্বাককে। ১৪ এবং রাজনীতিতে এগোলেন মার্কসের যুক্তিযুক্ত version (উপস্থাপন) ভদ্র সন্তান এবং শ্রমিককে তথা মজুরকে শিখিয়ে, নিজের অধিকার পুঁজিবাদী এবং সরকারের কাছ থেকে দাবি করতে—কেড়ে নিতে শিখিয়ে, নেতৃত্ব করে, জেলে গিয়ে। কিন্তু তিনি নিজের কাব্যের প্রতি উচ্ছ্বসিত হতে পারলেন না। অনিলের কথা* শুনে বোঝা গেছে, তিনি এটা কোনোদিন ভুলতে পারেননি। অন্যকে জানার জন্য যে কল্পনাশক্তির দরকার আছে, সেটা আমরা ভুলে যাই। আমি আগেও বলেছি, বাঙালির সবচেয়ে বড়ো দোষ—‘ভদ্রলোকি সুতরাং আমরা শুধুমাত্র ভদ্রলোকিভাবে এটাকে যেন না-বুঝি। সত্যি সত্যি নিম্নবর্গের দিকে যদি যেতেই হয়, তাহলে কল্পনাশক্তি না থাকলে চলে না। যাই হোক, বর্তমানে বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে, গোলকায়নের পরিপ্রেক্ষিতে, আন্তর্জাতিক মার্কসবাদের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিক আর কমিউনিজমের অধিকর্তা নয়। পশ্চিমবঙ্গে আমি কাজ করি বীরভূম আর ঝাড়খণ্ডের প্রান্তে। সেখানে বেশিরভাগ লোক কারখানা দেখেনি। গ্রামীণ মজুরের কথা বলতে হলে এম. এন. রায়, কমিনটার্ন এসবের কথা বলতে হয়, সেদিকে আমি যাচ্ছি না। কিন্তু গ্রামীণ মজুরদেরও এই * অনিল আচার্য, সম্পাদক অনুষ্টুপ, স্বাগত ভাষণ ৷ 

ডিক্টেটরশিপ অফ প্রোলেতারিয়েতের কথা শোনানো হয়। প্রমাণ শুনুন: 

দিল্লিতে গত ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮-য় অনুষ্ঠিত কৃষক-মজুরদের ‘সংঘর্ষ-র‍্যালি' নিয়ে কথা বলেছিলাম সিপিএমের স্থানীয় নেতা শিবদাস লোহারের সঙ্গে। ঘটনাটির বিষয়ে তার মতামত ও বিচারের প্রশ্নে শিবদাসের উত্তরটি শুনুন - 

শিবদাস: গত পাঁচই সেপ্টেম্বর দু-হাজার আঠেরোয় দিল্লিতে একটা ঐতিহাসিক মহাসমাবেশ সংসদ ভবনের সামনে সমাবেশ এবং তার আগে একটা র‍্যালি হয়েছে। সেটা—এই র‍্যালি সর্ববৃহৎ এবং সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এই র‍্যালি হয়েছিল। CITU অর্থাৎ শ্রমিক সংগঠনগুলো, AIKS অর্থাৎ অল ইন্ডিয়া কিষাণ সভা এবং সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন—এই তিনটি গণসংগঠনের উদ্যোগে এই শ্রমিক-কৃষক প্রতিনিধিদের যে ‘সংঘর্ষ র‍্যালি', সেই র‍্যালিতে সারা ভারতের ছাব্বিশটি রাজ্য থেকে বিভিন্ন গণসংগঠনগুলির নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ গরিব মানুষ, খেতমজুর-কিষাণ- শ্রমিক, তারা কাতারে কাতারে হাজির হয়েছিল। সেখানে আমি নিজেও ছিলাম। তাতে দেখলাম, এর আগে কখনও এইরকম মিছিল, এত বড়ো যে মহাসমাবেশ, ঐতিহাসিক সমাবেশ, ভারতবর্ষ জুড়ে, মানে ছাব্বিশটা রাজ্য জুড়ে, মানুষ কাতারে কাতারে তাদের জ্বলন্ত ইস্যুগুলো নিয়ে এসে দিনরাত থেকে তারা র‍্যালি গঠন করল, তাতে যেটা আমরা দেখতে পেলাম...মানুষগুলোর কারোর গেঞ্জি, কারোর জামা এবং বেশিরভাগটার টুপি, সকলেরই সেই...লাল এবং হাতে একটা করে লাল ঝান্ডা। 

এই যে বক্তব্য, এটা কলকাতায় শেখা। শিবদাস এরপর যা বলে যাবে তার মধ্যে কোনও বক্তব্য নেই। এই যে ভাষা, 'আমাদের দাবি মানতে হবে’-ভাষা—এগুলি শেখানো হয়েছে ওপর থেকে। এই ব্যাপারটার সঙ্গে আমার ঝগড়া (বিরোধ) আছে। যুক্তিগুলো কি এইভাবে শেখাতে হয় নাকি! এরপরে আমি আর একটা ভিডিয়ো দেখাব যেখানে ওই জায়গারই আমার স্কুলের এক টিচার-যে কোনোদিন ট্রেনে ওঠেনি—তার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা জানাচ্ছে। নাম—কাকলি। 

গায়ত্রী: তোমার নামটা বলো। 

কাকলি: কাকলি মণ্ডল। 

গায়ত্রী: এই গ্রামটার নাম বলো। 

কাকলি: সাহাবাদ। 

গায়ত্রী: তুমি আমার এখানে শিক্ষিকা, তাই তো? কাকলি: হ্যাঁ। 

গায়ত্রী: আমি যেটা জানতে চাই, সেটা হচ্ছে, তুমি কতদিন ধরে এখানে কাজ করছ? 

কাকলি: চার-পাঁচ বছর। 

গায়ত্রী: ধরা যাক, পাঁচ বছর। ঠিক আছে? 

কাকলি: হ্যাঁ। 

গায়ত্রী: তুমি এই গ্রামেরই বাসিন্দা। তুমি কী পাশ ? 

কাকলি: মাধ্যমিক পাশ। 

গায়ত্রী: মাধ্যমিক পাশ। আর তোমার স্বামী? ডাক্তার। তাই তো? 

কাকলি: ঘরোয়া ডাক্তার। 

গায়ত্রী: ঘরোয় ডাক্তার। তুমি মাধ্যমিক পাশ, তোমার স্বামী ঘরোয়া ডাক্তার। আমাদের বন্ধু। তোমাদের একটি ছেলে আছে, সে প্রাথমিক স্কুলে পড়ে, তাই তো? যেটা আমি জানতে চাইছি, সেটা হচ্ছে, একদম পরিষ্কার করে বলো এই পাঁচ বছরে, তোমার অভিজ্ঞতা, তুমি কী শিখেছ? কোনটা তোমার সব থেকে বড়ো শিক্ষা হয়েছে? কী শিখতে পেরেছ? কাকলি: অন্যের ছেলেকে কী করে নিজের ছেলের মতো মানুষ করা যায়, এটা আমি এখান থেকে শিখেছি। 

শিবদাস আর কাকলির বক্তব্যের এই যে তফাত, আমি এইটাই নির্দেশ করতে চাইছি। প্রথমটা একেবারে শেখা কথা—সকলের লাল ঝান্ডা, ইত্যাদি। আর দ্বিতীয় ভিডিয়োর মেয়েটি তাকে আমি কিছু বলে দিইনি—চিন্তা করে যেটা বার করল সেটা নিয়েই গণতন্ত্রের রহস্যের কথা বলেছিলাম। অন্য লোককে, অপরকে নিজের মতো করে ভাবতে পারা—এটাই কল্পনার flexibility 

আমরা বলব, বর্তমানের সাম্যবাদের অধিকর্তা নাগরিক, শ্রমিক নয় আর। বিভিন্ন রাষ্ট্রের, বিভিন্ন মহাদেশের, বিভিন্ন শ্রেণির, বিভিন্ন লিঙ্গের, বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন মনোভাবের নাগরিকদের সাধারণীকরণ একমাত্র রূপকায়িত ভবিষ্যৎ কল্পনার মধ্য দিয়ে সম্ভব এবং গোলকায়িত পুঁজিবাদ যা রাষ্ট্রকে ক্লীব করেছে, তার বিরুদ্ধে নাগরিকতা ছাড়া আর কোনও হাতিয়ার নেই। অবশ্যই সীমিতভাবে প্রাক্তন নিয়মে ‘আমাদের দাবি মানতে হবে' ধরনের বামপন্থাকে কাজ চালিয়ে যেতে হবে একই সঙ্গে, এবং রাষ্ট্রকে হুমকি দিয়ে মানবাধিকারের নামে গরিবের চাহিদা এক-এক করে আইনের মাধ্যমে মেটাতে হবে অবশ্যই। কিন্তু এতে শুধু সমস্যার উপর থেকে সমাধানের একটা চিরকালীন ধারা থেকে যায়। মনে রাখতে হবে যে আইন বদলালেই মানসিকতা অথবা মন বদলায় না। একেবারে নীচে আইন বদলানোর খবর তথাকথিত অনুগৃহীতদের কাছে পৌঁছোয় না, এবং মার্কসের যে ধারণা, শ্রমিকদল শুধু নিজের ভালো করবে না বরং জগতের শোষণ শেষ করবে, তা সম্পূর্ণ নিষ্ফল হবে সে-জায়গায়। নাগরিকতার রহস্য শুধু চাহিদা নয়, দায়িত্বও বটে। এসব নিয়ে আমি ‘সমর সেন স্মারক বক্তৃতা'য় আলোচনা করেছি গত জুনে। যদি কৌতূহল হয়, তবে ছাপা হলে পড়ে নেবেন।* বর্তমানে একটু দেখি, মার্কস নিজে কীভাবে রূপকের মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লবের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেছেন। 

আপনারা জানেন যে ১৮৭২ সালে, মার্কস এবং এঙ্গেলস ১৮৪৮-এর বিপ্লব এবং ১৮৭১-এর প্যারিস কমিউনের বিফলতার অভিজ্ঞতায় বলেছিলেন যে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'-র বিপ্লব-সংক্রান্ত অংশ- গুলিকে আর প্রাসঙ্গিক বলে মানার দরকার নেই। পুঁজিবাদের পঁচিশ বছরের বিকাশের অভিজ্ঞতায় ও শিক্ষায় মার্কসের এই বক্তব্য, কিন্তু আমরা যে-লেখাটি পড়েছি, লুই বোনাপার্টের এইটিস্থ ব্রুমেয়ার, সেটি সেই পঁচিশ বছর আগের লেখা। তাতে রূপকের মাধ্যমে ১৭৮৯-এর সফল এবং বৃহত্তর ফরাসি বিপ্লবকে পড়ে মার্কস যে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন, তার ঘা আমরা আজও খাচ্ছি। বহু রূপকের মধ্যে একটি আমি ধরছি: "Their ecstacies are short-lived. Soon they reached their high-point and the long hang-over pine society before they learn to make the results of their storm and stress period soberly their own." ইংরেজি অনুবাদে মূল লেখার 'hang-over'-কে করা হয়েছে 'regret', আর 'results'-কে 'achievement', কেন এভাবে অনুবাদ হয়? মার্কস একটা judgement দিচ্ছেন, অনুবাদে সেটা হারিয়ে গেল। রূপক হারিয়ে যাচ্ছে ইংরেজি অনুবাদে। যাই হোক, মার্কস বলছেন, ভবিষ্যৎকে ১৭৮৯-এর বিপ্লবীরা কল্পনা করতে পারেননি। তারা মাতাল হয়েছিলেন—এই পর্যন্ত। Hangover (জর্মনে Katzenjammer) কথাটির অর্থ পাঁড় মাতাল হবার পরের দিন বিরাট অস্বস্তিকর মাথাব্যথা। সুতরাং তাদের ওই সাংঘাতিক বিপ্লবের মোদ্দা ফল হল—রাষ্ট্রপতি-সম্রাট-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া। আজকের পৃথিবীর দিকে যদি তাকান, মার্কসের উক্তি-যা কাব্যিকভাবে কল্পনা করা, যুক্তিযুক্তভাবে নির্ণয় করা নয়—দেশে দেশে তার সত্যতা প্রমাণ করে। আরও শুনুন: “Hunted by the contradictory de- mands of his situation Bonaparte, like a conjuror, of necessity, has to at once keep the eye of the public fixed upon himself as a Napoleon-substi- tute by means of constant surprises by carrying out a coup d'état in miniatur every day. Thus Bonaparte brings the whole bourgeois economy into a tangle, violates everything that seemed in- violable to the Revolution of 1848, makes some patient and some desirous of revolution, and pro- duces anarchy in the name of order and at the same time strips the hals from and profane the state machine making it both disgusting and ri- diculous." এইভাবে মার্কস শেষ করছেন, যে ফ্রেঞ্চ রেভোলিউশনের একমাত্র ফল হয়েছে একসিকিউটিভ পাওয়ার বাড়ানোয় এবং তার মধ্যে ভেল্কি অথবা farce-এর ভূমিকা আছে। (আমি ভারতবর্ষের নাগরিক এবং থাকি আমেরিকায়, এই দুটো দেশে এ-কথার প্রমাণ অনেক ভাবে দেখা যাচ্ছে।) রূপকের মাধ্যমে পড়লে এমনও বলা যেতে পারে যে বিংশ শতাব্দীর সফল বিপ্লবগুলি শুধু গোলকায়নের সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করেছে। এটি যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। কিন্তু সেই প্রাসঙ্গিক আলোচনার সময় এখন নেই। মার্কস বলছেন, কাব্য-কল্পনা একটি ভবিষ্যৎদর্শী বিপ্লবপদ্ধতি এবং ভবিষ্যতের কবিতা, poetry of the future, Poesie der Zukunft—শুধুই অলংকার নয়। আজকের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই প্রশিক্ষণ নেই। সেই প্রতিষ্ঠানে অবহেলিত, অপ্রচলিত দৃষ্টিকোণ থেকে এখন দেখি, মার্কস বিপ্লবের সক্রিয় মুহূর্তটিকে কীভাবে রূপায়ণ করেছেন। 

প্রথমেই তিনি বিপ্লববাদী প্রোলেতারিয়েতকে একটি ধাপ্পাবাজের ভূমিকায় ফেলেছেন। এটাও জানা আছে আপনাদের। সেই যে ঈশপের গল্পে একটি ধাপ্পা ও গুলবাজ লোক বলেছিল, আমি রোডস্ (Rhodes ) বন্দরের এক ধার থেকে আর-এক ধারে লাফ দিয়ে পৌঁছোতে পারি। এর দূরত্ব কম করে সাতান্ন মিটার, আর সর্বোচ্চ অলিম্পিক রেকর্ড আট কিংবা নয় মিটার। যখন বাইরের জগতের নিদারুণ অবস্থা প্রোলেতারিয়েতকে বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করে, সেই উদ্বোধন হুলিয়াদের ধাপ্পাকে সামগ্রিকভাবে চ্যালেঞ্জ করে। বলে—সেই সুদূর রোডসে গিয়ে তোমায় ওস্তাদি দেখাতে হবে না। ধরে নাও এটাই রোডস্, এখানে ঝাঁপাও। দেখি তোমার কথা তুমি রাখতে পারো কি না! মার্কস ঈশপের লাতিন থেকে উদ্ধৃতি দেন: Hic Rhodus, hic salta! – এখানেই রোডস্ এখানে লাফাও। এই তো চ্যালেঞ্জ, দেখি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারো কি না। পর মুহূর্তেই মার্কস লাতিন উদ্ধৃতিকে জর্মন ভাষায় তরজমা করেন। অনুবাদ বলা যাবে না, কেননা তিনি ঈশপের ভাষাকে অনুসরণ করেন না, রূপায়ণ করেন। গ্রিক রোডস্ শুধু একটি জায়গার নাম নয়, কথাটির সাধারণ মানে গোলাপ ফুল। মার্কস রোডস্ জায়গাটিকে গোলাপ ফুলে রূপান্তরিত করলেন। তারই সঙ্গে লম্ফকে রূপান্তরিত করলেন নৃত্যে। জার্মান তরজমাতে ‘এই তো রোডস্, এখানে ঝাঁপাও', রূপ পেল ‘এই তো গোলাপ, এখানে নাচো'। ফুল ফুটেছে, নাচার সময় আর বেশিক্ষণ থাকবে না। Hier ist die Rose, tanze hier: আপনারা অনেকেই জানেন, প্রোলেতারিয়ান বিপ্লবযোদ্ধাদের প্রতি ব্যক্ত এই পঙ্ক্তিটি হেগেলের”, মার্কসের নয়। আমার আজ সসম্মান নিবেদনে হেগেলের মার্কসীয় রূপান্তর উত্থাপন করা নিতান্তই ধৃষ্টতা হবে। এইটুকু বলছি, এই উদ্ধৃতির সাহসী অপপ্রয়োগ থেকে হেগেলের মার্কসীয় রূপান্তরের ইঙ্গিত করা যায়। আপনারা হয়তো ভাবছেন, এইভাবে মার্কসকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধরে শাস্ত্রপাঠের মতো করে পড়লে কী কমিউনিস্ট হওয়া যায়? 

মূল বক্তব্য থেকে অবসর নিয়ে এ সম্বন্ধে চারটি কথা বলি: প্রথমত, কমিউনিস্ট হওয়া যায় না। সোশালিস্ট হওয়ার আইনসঙ্গত আজীবন চেষ্টার প্রবৃত্তি-সংযমের যে-ভূমিকা আছে, সেটা একমাত্র কল্পনা-বিকাশেই স্থায়ী হয়। দ্বিতীয়ত, পড়ি-কী-মরি কোনো সংঘবদ্ধ কাজের সময় এমন ভাবতে বসলে চলে না। এই কাজটি শেখার যদি সময় পাওয়া যায় তবেই skilled labour বলতে পারেন। তৃতীয়ত, ভালো করে প্রাণ দিয়ে এই পড়ার ধরনটা শেখালে এটা মানসিক অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যায়। খেলার মাঠে খেলোয়াড়ের প্রতিটি দৈহিক চাল যেমন মাস্‌ল মেমরি থেকে আসে, ভেবেচিন্তে আসে না, বিপ্লবের মাস্ল মেমরির বিশ্লেষণী শক্তিও সেইভাবে কল্পনার মাস্ল মেমরিকে বলিষ্ঠ করে। চতুর্থত, ক্ষেত্রে কর্ম বিধীয়তে। নব্বইয়ের দশকে যখন—সক্রিয় কর্মী সাধারণ শিক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ পলাশ বড়ালকে বিলেতে পাঠানো হচ্ছে, তখন ফরহাদ আমাকে ধরেছিল, “দিদি ওকে নিয়ে একটু বোসো।' আমি ইংরেজি পরিভাষাগুলো অবশ্যই ফর্দ করে দিয়েছিলাম, বলেছিলাম – 'যা পারবে বলবে, আস্তে আস্তে পরিষ্কার করে মুখ খুলে। তুমি যেমন ওদের কথা ঠিক বুঝতে পারবে না, ওরাও তেমনি তোমার কথা বুঝতে নাও পারে।' অর্থাৎ 'অপর'কে একটু কাছে আনার চেষ্টা করলাম। ভরাটি বিষয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা- ও যেটা মোক্ষম জানত—আর গোলকায়ন—যেটা সম্বন্ধে ওর ধারণা ছিল, ও কিছুই জানে না—দুটোকে সহজ যুক্তিতে, ওর প্রশ্নের উত্তরে-উত্তরে, কাছে আনবার চেষ্টা করলাম। অর্থাৎ ওকে পড়বার চেষ্টা করলাম, ওরই সাহায্যে। শেষে ও বলল, “দিদি, আপনি কোনোদিন আমাদের সঙ্গে লেবারের সামনে দাঁড়াননি, এত সূক্ষ্মভাবে কী করে জানলেন কী হয় না-হয়!' ওর দুই হাত ধরে বললাম, ‘পলাশ, কী খেতাব দিলে আমায়।” ওর সঙ্গে দেখা হল কয়েক মাস আগে যখন রোহিঙ্গা আন্দোলনে ঢাকা যাই। শরীরটা খারাপ হয়েছে দেখলাম। কিন্তু উজ্জ্বল চোখে বলল, “দিদি, সেই আলোচনা আমাকে বদলাল।' আর আমি সত্যি কথাটাই বললাম, ‘আমাকেও।' ধরুন, এই শিবদাস লোহার, যার কথা শুনলেন, সিপিএম-এর আঞ্চলিক নিম্নবর্গীয় ডানহাত ছিল। অসাধারণ বুদ্ধি, কিন্তু মাধ্যমিক দেওয়ার সুযোগ পায়নি। তাকে কেউ বোঝায়নি যে, পুঁজিবাদের যুক্তিযুক্ত বিকাশ surplus value চুরি করে, এটাও বোঝায়নি যে, primitive accumulation-এর সঙ্গে চাষির ভূমিকা, তার সম্পর্ক আছে। আমি যখন সোজা করে বলছি, সে বলছে, “দিদি, বাংলায় এমন বুঝিয়ে বই লেখেন না কেন!' আমি বললাম, “বই পড়ার লোক তুমি নও মোটেই।' কী করে বার করলাম যে নীচে-উপরে, দু-জায়গাতেই, বই ব্যবহার করতে হিউম্যানিটিজের মাইনে-করা শিক্ষকের কাজ-সে-গল্প শেখানো ব্যবহার করার সময় নেই। শিবদাস চুরি করত, ঘুস নিত। তাকে বললাম, ‘বাবু–লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। লোভ কিন্তু স্বাভাবিক। সেখান থেকেই তোমার ছিঁচকে চুরি থেকে বিশ্বজোড়া দুর্ধর্ষ পুঁজিবাদ এগোয়।' বলা যেতে পারে লোভে ‘লাভ’! পাপ না হাতি, লোভে লাভ। একের লাভে সকলের মৃত্যু। 'সবার ওপরে মানুষ সত্য’২২--এই কথাটা অর্ধসত্য—কল্পনাকে স্বভাববিরুদ্ধ শিক্ষা, অমানুষিক শিক্ষা দেওয়ার উপর নির্ভরশীল। আজ সে-শিক্ষা কোথায়! গ্রামশি বুঝেছিলেন যে মার্কসের পরিকল্পনা চিন্তার ধরন বদলানোর উপর নির্ভরশীল এবং সেখানে কল্পনার প্রয়োজন আছে। 

যাক, চারটি কথা বলা হল: স্বভাববিরুদ্ধ কল্পনার অভ্যাস, মনের মাস্ল মেমরি দিয়ে রোগ নাকচ করা এবং ক্ষেত্রে কর্ম বিধীয়তে জেনে কাজ করা। আরও দুটি কথা বলে মার্কসের হেগেল উদ্ধৃতিতে ফিরে যাব। 

Frontline ২৪-এ একজন আমার পড়ার পদ্ধতিটিকে নিজের মতো করে বর্ণনা করেছেন। এটা একমাত্র আমার পদ্ধতি নয়। যদিও লোকে স্বীকার করতে চায় না, অন্যরকমভাবে বলে। যাক, লেখাটিতে বক্তা রূপকের ইঙ্গিতকে বলেছেন, 'ফ্ৰয়েডিয়ান স্লিপ', আর পাবলিক ইন্টারেস্ট এই বাক্যাংশটিকে রূপকের মতো বহু তাৎপর্যের ব্যঞ্জনার মাধ্যমে বলে ধরে নিয়েছেন। পড়ছি, শুনুন: "Officialese has an extraordinary knack of often reflecting the real story behind complicated or murky developments in government or the larger institutional establishment. In many ways, they become manifestations of political and bureucratic Freudian slips (metaphor), which in turn are pointers to significant trends of the present or the future." লেখক এটা বলছেন একজন রিটায়ার্ড সিনিয়র ইনটেলিজেন্স অফিসার সম্বন্ধে। তিনি বলছেন, "[He] drew attention to the phrase "in the public interest"...", এটার সম্বন্ধে লেখক কিছু আলোচনা করলেন এবং বললেন, "The former of - ficer pointed out that invoking the 'public inter- est' had multiple and suggestive implications." এ-হল রূপকের মাধ্যমে বার করা বহু তাৎপর্য ও কল্পনার প্রকাশ। 

আর এমন করে মার্কস পড়াটা বাতুলতা—এই কল্পিত অভিযোগের উত্তরে ক্ষেত্রে কর্ম বিধীয়তের শেষ উদাহরণ আমি দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু সময়াভাবে দিচ্ছি না। এত কিছু বলার কারণ এইটাই— আপনারাও তো ক্ষেত্র, কলকাতার সংস্কৃতি ও চিন্তার জগৎ, যেখানে আমার আনাগোনা সীমিত, এই ক্ষেত্র আমাকে এরকম অনড় বাংলা টীকাবাদের আলিঙ্গনে ফেলেছে। বাংলা আমার পেশাগত ভাষা নয়, শুধুই মাতৃভাষা। আর এই প্রবন্ধে [Eighteenth Brumaire of Louis Bonaparte] মার্কস, বিপ্লব অস্বাভাবিক এবং লোভ স্বাভাবিক বলেই হয়তো, বিপ্লবের উপমা দিয়েছেন বিদেশি ভাষা ভালো করে শেখা। বিদেশি ভাষা এত ভালো করে শেখা যাতে সেই বিদেশি ভাষায় কথা বলার সময় মাতৃভাষায় আর চিন্তা করতে না হয়। আমি আপনাদের ধরবার জন্য বাংলাকে বিদেশি ভাষা করেছি। কিন্তু আপনাদের প্রাঙ্গণে আমি বিপ্লবী হতে পারব না। মার্কস যেভাবে হেগেলকে হৃদয়ঙ্গম করে অন্তরে ঢুকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন, সেই আত্মীয়তায় আমি আপনাদের সঙ্গে ঢুকতে পারব না। হেগেল ‘এই তো গোলাপ, এখানে নাচো' লিখেছিলেন 'রসিক্রুশিয়ানিজম নামক মাদাম ব্লভাৎস্কি [Madame Blavatsky] -র স্টাইল জ্যোতিষীবাদকে রূপক ধরে, দার্শনিক শ্রেণিকে বর্তমানে আবদ্ধ থাকতে অনুরোধ করে: "To recognise reason as the rose in the cross of the present. This ratio- nal insight is the reconciliation which philosophy grants to those who have received the inner call to conceptualise." 

মার্কস, এই দার্শনিক শ্রেণির যুক্তি দিয়ে বর্তমানকে মেনে নেওয়াকে শ্রমিকশ্রেণির ভবিষ্যৎকে কবিতায় ধরাতে পরিবর্তন করেছেন। এটা প্রোলেতারিয়েতের বহির্জগতের আদেশে অন্তর থেকে প্রতীতি প্রমাণ হিসেবে। ভেবে দেখুন: ‘এই ধাপ্পাবাজ হুলিয়া, এইখানে লাফাও, মিথ্যেবাদী কোথাকার!” —এইভাবে প্রোলেতারিয়েতকে সম্বোধন করেছেন ঈশপ। হেগেল প্রোলেতারিয়েতকে বললেন, বর্তমান ও যুক্তিকে ধরতে পারে শুধু দার্শনিক। আর সেই রূপককে ব্যবহার করলেন মার্কস; উল্টো গলায় বললেন, ফুল ফুটেছে, বুঝেছ তো? এই নাচের সময়, নাচো। তাল রেখে, ছন্দ মেনে—তার মধ্যেই স্বাধীনতা। নায়কী-গায়কীর যথার্থ সমন্বয় প্রতি পদে নির্ণয় করেই এই স্বাধীনতা। এই তো গণতান্ত্রিক নাগরিকের ব্যবহার, যেটার অস্তিত্ব প্লেটো ধরে নিয়েছিলেন। আমরা তো পারব না। ওড়িশায়, ক্যান্সারে জর্জরিত শেষ দেবদাসীর ছেলের বিশ্বাস অর্জন করতে পারায়, তিনি বলেছিলেন আমাকে- ‘কলাক্ষেত্রে নাচ আর আমাদের মায়েদের নাচের তফাত হচ্ছে যে, আমাদের মায়েরা সমানেই বানাতেন।' অর্থাৎ ভাষাত্মকভাবে আমি বলব, এবং বুঝব, যে তিনি নতুন বানান করতেন। মার্কস প্রোলেতারিয়েতের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক নিজে স্থাপন করতে পারেননি, শ্রেণিবিভেদে আবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু তাঁর ব্যবহৃত রূপক আমাদের ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক স্থাপন করবার নির্দেশ দিল। দুর্ভাগ্যবশতঃ, কল্পনাকে বলিষ্ঠ করবার, কর্মিষ্ঠ করবার শিক্ষা আজ আর নেই। কাজেই সেই নির্দেশ আমরা আমাদের লোভী জীবন ছেড়ে অনুসরণ করতে পারি না। বুঝতে পারি না, মার্কসের এই নাচের কল্পনার সঙ্গে আমাদের মরণ-বাঁচন নাচে, দেবদাসীদের নাচের মতো খেলা-ভাঙার খেলা। আমরা শুধুমাত্র কল্পনাকে শক্ত করে এই নাচের প্রস্তুতি শেখাতে পারি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শুধু এই ভাঙার নাচে বিপ্লব নয়। যুক্তি দিয়ে যদি বর্তমানকে পরিকল্পনা না করা হয়, বাজেট নিয়ে ধোঁকা, এরোপ্লেন কেনা নিয়ে ধোঁকা, সিবিআই নিয়ে ধোঁকা, এফডিআই নিয়ে ধোঁকা, ধর্মের শুচিবাইকে যুক্তিসংগত আইন বানানো—এই শক্তির লোভকে আটকানোর উপায় যদি কল্পনার শিক্ষার বাইরে থাকে, তবে খেলা শুধু ভাঙাই হবে, গড়া কোনোদিন হবে না। পরিণত কল্পনা যুক্তিকে বাঁচিয়ে রাখে, যুক্তিকে রক্ষা করে। নইলে নিযুক্তিক নিম্নবর্গের অশিক্ষিত কল্পনা সংখ্যাগুরুর দেহগোনার হিংস্র চোখ শাসানোর খুনোখুনির ভোটে সারা জগৎকে নিশ্চুপ বানায়। আজকের ভারতবর্ষে বসে, যুক্তরাষ্ট্রে বসে, তুরস্কে বসে, অস্ট্রিয়ায় বসে, ফিলিপাইন্‌সে বসে, ব্রেজিলে বসে কার স্পর্ধা আছে অস্বীকার করবার যে মার্কস রাষ্ট্র সম্বন্ধে ভুল করেছিলেন। অবশ্য ১৮৭২ সালে, যখন মার্কস- এঙ্গেলস দুই বন্ধু কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-র বিপ্লবাত্মক অংশ নাকচ করে লিখলেন—১৮৭১ সাল বুঝিয়ে দিল যে উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত রাষ্ট্রের কল দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়া যায় না, তখন সে-ভুল তাঁরা স্বীকার করেছিলেন। 

('রাষ্ট্রের কল' – Frontline-এর 'Public interest'-এর মতো এটাও তো রূপক।) 

আমি চার্বাক পড়িনি। চার্বাকের উপর দেবীপ্রসাদও তো পড়িনি। আগে এমন অবস্থায় পড়লে বিমলকৃষ্ণ মতিলালকেও ফোন করতাম। এখন আমার দার্শনিক দিদি তারা চাটুজ্যের* শরণাপন্ন হই। তিনি বললেন, ছাত্রাবস্থায় পড়েছেন দেবীপ্রসাদের চার্বাক। চার্বাকের যুক্তিযুক্ত রূপকে তিনি সসম্মানে তুলে ধরেছেন, এবং এও বললেন যে ভারতীয় দর্শন চার্বাককে ফেলতে পারেনি, সর্বদা পূর্বপক্ষে রেখেছেন যাতে যুক্তি তাকে নিরীক্ষণ করতে পারে। দেবীপ্রসাদের আত্মজীবনী কিছুটা পড়ে ধরতে পেরেছি যে তাঁর বাংলা-ইংরেজি মার্কসের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং সাহিত্যের সঙ্গে উনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। কিন্তু নেতৃত্বের সময় যুক্তিবাদীর জোর গলা ছিল কিনা সেটা বোঝার জন্য মন দিয়ে সময় করে আরো পড়তে হবে, এবং শেষমেশ বুঝতে পারব না, কেননা এটা বুঝতে হলে কর্মক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে ঢুকতে হত। আর-একটি রূপক দেখে আমরা কবিতায় যাব। 

এই যে প্রবন্ধটি (Eighteenth Brumaire) পড়ছি, তাতে ইংরেজি অনুবাদে আমরা পড়ি: "Man makes his own history but not of his own free will." মার্কস নিজে কিন্তু 'free will' জাতীয় কোনও কথা বলেননি। তিনি লিখেছেন—‘মানুষ নিজে ইতিহাস তৈরি করে, কিন্তু কোন নাটকে তার কী ভূমিকা, সেটা নিজে নির্বাচন করতে পারে না। 

আর এই প্রবন্ধেই লিখেছেন, প্রথম ফরাসি বিপ্লব ও এই দ্বিতীয় পর্যায়কে তুলনা করে, "first time as trag- edy, second time as farce." বর্তমানে আমাদের নির্দিষ্ট ভূমিকা farce অথবা প্ৰহসন: রোদে রাঙা ইঁটের পাঁজা তার উপরে বসল রাজা- ঠোঙা ভরা বাদাম ভাজা খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না। 

গায়ে আঁটা গরম জামা পুড়ে পিঠ হ'চ্ছে ঝামা; রাজা বলে “বৃষ্টি নামা— নইলে কিচ্ছু মিল্‌ছে না। ” এতো ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর প্রতি হুমকি, ফরাসি বিপ্লবের উত্তরাধিকার, নেতার ক্ষমতা বৃদ্ধি। ‘নইলে কিচ্ছু মিলছে না’–যুক্তির আক্ষেপ। Statistical প্রশ্ন—‘নেড়া বেলতলায় যায় কবার এক এবং তার উত্তর statistical average - “ হরেদরে হয়তো মাসে নিদেন পক্ষে পঁচিশবার।” ইঁটের পাঁজার ওপর বসে আমরা হাউমাউ করে নেতাবাজি করে চলেছি। কিন্তু ভোটের কল চলছে অন্য তেলে। যুক্তি উন্নাসিক, আর কল্পনা নতজানু হয়ে প্রার্থনা করে অপরাশক্তির জন্য, যাতে অকারণে ‘অপর’ তার উপর ভর করে, ব্যর্থ হয়; কিন্তু ব্যর্থতা থেকে শেখে—ভাঙাগড়া ভবিষ্যতের জন্য। এই তো ইতিহাস। 

এবার একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিই। আর সুখের প্রশ্বাসটি ছেড়ে দিই হলের হাওয়ায়। তিনটি কবিতা পড়ি। প্রথম দুটি আমাকে জোর করে পড়াবার জন্য অরিন্দম চক্রবর্তীকে ধন্যবাদ জানাই।



বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক! সাধ্যের মধ্যে থাকলে বইটি কিনবেন এই প্রত্যাশা রইলো।

Post a Comment

0 Comments