Ticker

6/recent/ticker-posts

গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ - প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সামরিক শাসন - মওদুদ আহমদ

amarboi.com বাংলাদেশে সুষ্ঠুভাবে গণতন্ত্র বিকশিত হতে না পারার প্রধান কারণ হলো ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক এক দলীয় শাসন কায়েম এবং পরবর্তীতে দেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ। এদেশের প্রথম কুড়ি বছরের মধ্যে পনের বছরই দু’জন সামরিক প্রধানের অধীনে দেশ পরিচালিত হয়, যেখানে উভয়ের মধ্যে যেমন ছিল সাদৃশ্য তেমনি ছিল বৈসাদৃশ্যও। জিয়া এবং এরশাদের সময় সাংবিধানিক শাসন, লোক প্রশাসন এবং আদালতের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা ব্যাহত হয় এবং রাজনীতিতে সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করা হয়। কোন গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ না করে তাঁরা সামরিক আইন বা ডিক্রীর মাধ্যমে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁরা দেশ শাসনে রাজনীতিবিদদের চাইতে আমলাদের উপর বেশি নির্ভর করেছেন। তখন রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা রাজনীতিবিদদের হাত থেকে আমলা ও টেকনোক্র্যাটদের কাছে চলে যায়। ফলে সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থার চরিত্র ও রূপ বদলে যায় এবং দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকট সৃষ্টি হয়। বইটি বাংলাদেশের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী মওদুদ আহমদ কর্তৃক রচিত একটি অনন্য গ্রন্থ। দেশে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তিনি উল্লেখিত দুই সরকারের অধীনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে সামরিক শাসকরা কিভাবে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক উপাদানসমূহকে বিনষ্ট করে এই গ্রন্থে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। লেখক বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি চমৎকার চালচিত্র তুলে ধরেছেন এই বইতে। এটা শুভ দিক যে, বাংলাদেশ পুনরায় গণতান্ত্রিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। যদিও এই বিষয়টি এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তবে এই বইয়ে লিপিবদ্ধ ঘটনা এবং ইস্যুসমূহ বাংলাদেশ ও তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের যাত্রাকে ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।
কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের ফাঁসি হয় সামরিক ট্রাইব্যুনালে ১৯৭৬ সালে। সেই বিচার ছিল গোপন বিচার। সেই বিচার সম্পর্কে প্রকাশ্যে জানবার কোনো সুযোগ ছিল না। হালে মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের আত্মীয়দের আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টে এই হত্যা মামলার শুনানি চলছে। সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেই গোপন বিচারের নথি আদালতে হাজির করতে। কিন্তু নথির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
আদালত তখনকার দায়িত্বশীল সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের বক্তব্য শুনবার উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রসঙ্গে আদালতে আলোচিত হয়েছে মওদুদ আহমদ-এর ‘গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ, প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সামরিক শাসন’ শীর্ষক বইটির কথা।
সাবেক সামরিক শাসক এরশাদ, বিএনপি নেতা জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রী সভার সদস্য ছিলেন মওদুদ আহমদ। মওদুদ আহমদ রচিত এই বইয়ের ২৬-২৯ পৃষ্ঠার কিছু অংশ। সম্পূর্ণ বইটির ডাউনলোড লিঙ্ক নিচে দেওয়া হলো।

নবেম্বর ২৩ রাতে, মুক্তি পাবার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে এম এ জলিল, আ স ম আব্দুর রব এবং অন্যান্য জাসদ নেতাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন আধা সামরিক বাহিনী আবু তাহেরের বাড়ি ঘেরাও করে এবং তাঁকে অন্তরীণাবদ্ধ করা হয়। ক্রমান্বয়ে দেশব্যাপী বিপুলসংখ্যক জাসদ কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়। সরকারের এই তৎপরতায় জাসদ কর্মীরা আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়।
জিয়া এখানেই থেমে থাকেননি। সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে তিনি বিদ্রোহী সংগঠন এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাহেরের বিচার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনী থেকে জাসদপন্থিদের উৎখাত করা। এতদুপলক্ষে তাহের এবং অন্যান্য প্রথম সারির নেতাদের ওপরই প্রথম কোপদৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয়। ক্যান্টনমেন্টসমূহে সংঘটিত ঘটনাবলি, বিশেষ করে অফিসারদের হত্যার পর সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ বিরাজ করছিল একটা নিরাপত্তাহীনতা এবং অভ্যুত্থানের নায়কদের শাস্তি দেবার জন্য ক্রমশ চাপ দেয়া হচ্ছিল। মামলার আয়োজন করতে সরকারের প্রায় ছয় মাস সময় লেগে যায়। ১৯৭৬ সালের মে মাসে তাহেরকে হেলিকপ্টারে করে রাজশাহী থেকে ঢাকা এনে কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্জন প্রকোষ্ঠে অন্তরীণ রাখা হয়। তিন সপ্তাহের মধ্যে একটি অধ্যাদেশ বলে গঠন করা হয় একটি বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল। পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা অফিসার কর্নেল ইউসুফ হায়দারকে এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়।
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, এই বিচার করা হবে পর্দার অন্তরালে এবং সংবাদ মাধ্যমে এর কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করতে দেয়া হবে না। আইনজ্ঞরা বিচারের আগে গোপনীয়তা রক্ষা করার ব্যাপারে শপথ করবেন এবং তাহেরের বিচারকার্য সম্পন্ন হবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে। এর আগে কারাগারের অভ্যন্তরে এমন ধরনের আর কোনো বিচারের আয়োজন করা হয়নি।৫০ তাহের বাদে আরো ৩২ জনকে একই অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এঁদের মধ্যে ২২ জন ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য এবং বাকিরা ছিলেন জলিল, রব, সিরাজুল আলম খান, মো. শাহজাহান, মাহবুবুর রহমান মান্না, হাসানুল হক ইনু, ড. আখলাকুর রহমান এবং সাপ্তাহিক ওয়েভ পত্রিকার সম্পাদক কে বি এম মাহমুদের মতো জাসদের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ।
নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ১৯৭৬ সালের ২১ জুন কারাগারের অভ্যন্তরে বিচারের কাজ শুরু হয়। একই বছর ১৭ জুলাই তা সমাপ্ত হয়। একই দিনে ট্রাইব্যুনাল ফাঁসিতে তাহেরের মুত্যুদ-াদেশ কার্যকর করার পক্ষে রায় ঘোষণা করে। অন্যান্য জাসদ নেতাকেও বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দেয়া হয়। জলিলকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদ-, রবের ১০ বছর এবং মেজর জিয়াউদ্দিন ও সিরাজুল আলম খানের পাঁচ বছর করে কারাদ-াদেশ বহাল থাকে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ফাঁসির দ-াদেশপ্রাপ্ত ক্ষুদিরাম বসু এবং সূর্যসেনের পরে এই প্রথম রাজনৈতিক কারণে কারো বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-াদেশ প্রদান করা হলো। আদালতে তাহের নিজের জীবনবৃত্তান্ত, প্রেক্ষাপট, মুক্তিযুদ্ধকালে নিজের ভূমিকা, একজন মেধাবী সেনা অফিসার হিসেবে তাঁর কর্মতৎপরতা এবং ৬ ও ৭ নবেম্বরের সিপাহি-জনতা অভ্যুত্থানে তাঁর ভূমিকার বিশদ বিবরণ দিয়ে এক সুদীর্ঘ বিবৃতি প্রদান করেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং সিপাহি বিদ্রোহের অভিযানের প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন-
এটা একটা রেকর্ডকৃত নথির অংশবিশেষ যে, ১৯৭৫ সালের ৬/৭ নবেম্বর রাতে কতিপয় ষড়যন্ত্রকারীর অসৎ উদ্দেশ্যমূলক ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার লক্ষ্যে আমার নেতৃত্বে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একটি সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এতে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অন্তরীণদশা থেকে মুক্ত করা হয় এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা হয়। এটা যদি রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে তাহলে সে অপরাধে আমি অপরাধী। আমি যদি কোনো অপরাধ করে থাকি, তবে তা হলো শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন করার অপরাধ, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অপরাধ, দেশের সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফকে অন্তরীণদশা থেকে মুক্ত করার অপরাধ এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর আমার অগাধ আস্থা স্থাপনের অপরাধ।
তাহের আরো দাবি করেন যে তিনি জিয়া এবং প্রধান বিচারপতি সায়েমকে এই মর্মে সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন যে, সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দেয়া হবে, রাজনৈতিক কর্মকা- শুরু করার অনুমতি দেয়া হবে এবং জনগণের সরকার কায়েমের জন্য অনুষ্ঠিত হবে একটি সাধারণ নির্বাচন। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, গৃহবন্দি থাকাকালে ভোর চারটার সময় জিয়া তাঁকে টেলিফোন করে তাঁর সাহায্য ভিক্ষা করেন এবং ৪ নবেম্বর জিয়া সৈন্যসহ সেখানে গিয়ে তাঁকে মুক্ত করার জন্য তাহেরের কাছে একটি গোপন বার্তা প্রেরণ করেন। এরপর তিনি কিভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা বর্ণনা করতে গিয়ে আদালতে তাহের বলেন :
আমাদের সেনাসদস্যদের সঙ্গে গভীর আলোচনা ও যোগাযোগের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। ৬ নবেম্বর আমি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সকল ইউনিটের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং আমার পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করার জন্য ইউনিট প্রতিনিধিদের মাধ্যমে আহ্বান জানাই। ৬ নবেম্বর শেষ রাত নাগাদ ইউনিটের সকলেই ছিলেন পুরোপুরি সজাগ। পরিকল্পনা নেয়া হয় যে, ৭ নবেম্বর প্রত্যুষে সেনা অভ্যুত্থান শুরু করা হবে। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল (১) ক্ষমতা কোটারি হতে খালেদ মোশাররফকে অপসারণ করা; (২) জিয়াউর রহমানকে অন্তরীণদশা থেকে মুক্ত করা; (৩) একটি বিপ্লবী সামরিক কম্যান্ড কাউন্সিল গঠন করা; (৪) দলমতনির্বিশেষে সকল রাজবন্দির মুক্তি প্রদান করা; (৫) রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর থেকে সকল আটকাদেশ রহিত করা; (৬) বাকশাল বাদে অন্য সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করা এবং (৭) বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ঘোষিত ১২ দফা দাবিনামা বাস্তবায়ন করা।
তাহের বলেন, গোড়া থেকেই সব কিছু অগ্রসর হচ্ছিল পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী। তিনি বলেন :
প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে রেডিও, টেলিফোন, টিভি, পোস্ট অফিস, এয়ারপোর্ট এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলো দখল করা হয়। প্রত্যুষে জিয়াকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় সেকেন্ড আর্টিলারি হেডকোয়ার্টার্সে। সকাল তিনটার কাছাকাছি সময়ে আমি আমার বড় ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানকে সঙ্গে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে যাই। সেখানে আমি জিয়াকে নাইটড্রেস পরিহিত অবস্থায় ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী ও আরো কতিপয় অফিসার এবং সিপাহির সঙ্গে কথাবার্তা বলতে দেখি। জিয়া আমাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করেন, তাঁকে রক্ষা করায় আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, তাঁর প্রাণ রক্ষা করায় তিনি আমার এবং জাসদের প্রচেষ্টার কাছে ঋণী। তিনি বলেন, তিনি এত কৃতজ্ঞ যে, আমরা তাকে যা করতে বলব তিনি তাই করবেন। আমরা তাঁর সঙ্গে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করি এবং সকাল আনুমানিক ৪টার দিকে বেতার ভবনে (রেডিও বাংলাদেশ) যাই। পথে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করি।৫৪ সেনাবাহিনীতে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা এবং অসন্তোষের অভিযোগ সম্পর্কে তাহের ১৫ আগস্ট এবং ৩ নবেম্বর সংঘটিত ঘটনাবলি বিবেচনা করার জন্য ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন জানান। তিনি বলেন, সে সময় সংঘটিত হত্যাকা- ও অন্যান্য ঘটনার জন্য কোনো অফিসারকে দোষীসাব্যস্ত করা হয়নি বা কোনো বিচারের আয়োজন করা হয়নি। পক্ষান্তরে ১৫ আগস্ট হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত অফিসাররা বরং তাদের ঊর্ধ্বতন অফিসারের বরাবরে নির্দেশনামা পাঠিয়েছে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর চেইন অব কম্যান্ড ইতিপূর্বেই বার বার বিখ-িত হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, অসন্তোষ এবং বিশৃঙ্খল অবস্থা সেনাবাহিনীতে অনেক আগে থেকেই বিরাজ করছিল।
আইনের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত একটি সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ সম্পর্কে তাহের পুনরায় শেখ মুজিব এবং তাঁর পরিবারকে হত্যাকারী ঘটনাসমূহ দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, মুশতাক জিয়াকে চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত করেছিলেন, সেই মুশতাকের সরকারকেও এক সময় উৎখাত করা হয়েছিল। ‘সে ব্যাপারে কিছুই করা হয়নি। কাউকে বিচার করা হয়নিÑউপরন্তু তাদের সকলকে করা হয়েছে পুরস্কৃত। বর্তমান জিয়া সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা- এবং পরবর্তীকালে খালেদ মোশাররফকে ক্ষমতাচ্যুত করার ফলেই ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়েছেন।’
তাহের আরো উল্লেখ করেন, ৭ নবেম্বর অভ্যুত্থানে সবচাইতে বেশি লাভবান হয়েছেন জিয়া এবং এই অভ্যুত্থান না ঘটলে এতদিন তিনি বেঁচেই থাকতেন না। জিয়াকে মুক্ত করার ঘটনা বর্ণনা করে তিনি বলেন, আমার নির্দেশে পরিচালিত অভ্যুত্থানে জিয়া আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছেন।৫৬ তিনি এই বলে তাঁর বিবৃতি শেষ করেন যে, জিয়া তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর ভাষায় ‘আমাদের ইতিহাসে এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকতার একটি মাত্র দৃষ্টান্ত রয়েছে। সেটা হলো মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতাÑ যিনি বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করায় আমাদের ২০০ বছরের জন্য দাসত্ব বরণ করতে হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে এটা ১৭৫৭ সাল নয়। এটা ১৯৭৬ সাল। আমাদের রয়েছে বিপ্লবী সৈনিক এবং বিপ্লবী জনগণ যারা জিয়াউর রহমানের মতো বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রের সমুচিত জবাব দেবে।
১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ভোর চারটায় ফাঁসিতে তাহেরের মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকর করা হয়। এর ফলে দেশের রাজনৈতিক আকাশে কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস পরিলক্ষিত হয়নি। এর প্রধান কারণ ছিল এই যে, বিচার অনুষ্ঠিত হয় পর্দার অন্তরালে কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে এবং সংবাদ মাধ্যমের ওপর জারি ছিল কঠোর নিষেধাজ্ঞা। অন্যদিকে শহরের প্রকাশ্য সংগঠন জাসদের প্রথম সারির সকল নেতাই ছিলেন অন্তরীণ। যা-ই হোক, দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী মহল, এমন কি অনেক বিদেশি সংগঠন ও ব্যক্তিত্বও তাঁর প্রাণ রক্ষার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান। তাহের নীরবে মৃত্যুবরণ করলেও দেশের রাজনৈতিক মহল এবং সামরিক অঙ্গনে এই মৃত্যুদ-াদেশের কারণে প্রবল প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করা গেছে। যাঁরা ৭ নবেম্বরের অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছেন এবং যারা করেন নি, সকলের মধ্যেই এই ঘটনা এক বিষময় প্রভাব রেখে গেছে। তাহের যে রাজনৈতিক বাণী রেখে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন তা সশস্ত্রবাহিনীর সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং তা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নে সুগভীর প্রভাব বিস্তার করে রাখে।
প্রশ্ন থেকে যায় : যে তাহের জিয়াকে অন্তরীণাবস্থা থেকে মুক্ত করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করলেন, জিয়া কেন তাঁর মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকর হতে দিলেন? স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তাঁরা একই সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন এবং দীর্ঘদিন যাবৎ পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত ছিলেন।৫৮ স্বাধীনতার পরে জিয়াকে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত অফিসারদের সঙ্গে ভারসাম্য বিধান করে সেনাবাহিনীতে নিজের অবস্থান জোরদার করতে হয়েছে। যে সমস্ত অফিসার সরাসরি যুদ্ধে যাননি, শেখ মুজিব হত্যাকা- এবং মুশতাকের অপসারণের পর তাঁরা জিয়ার মধ্যে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে একজন বন্ধু খুঁজে পান। দেশের সামরিক-বেসামরিক ক্ষমতা কাঠামোতে একটি শ্রেণী ও শক্তি হিসেবে টিকে থাকার জন্য এঁরা পরস্পরের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছিলেন। তাহেরের মৃত্যুদ-াদেশের প্রশ্নে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসাররা সবসময় ইতিবাচক সায় দিয়েছেন। এ ব্যাপারে জিয়া ৪৬ জন সিনিয়র সামরিক অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং সকলেই একবাক্যে তাহেরের জন্য চূড়ান্ত শাস্তির পক্ষে সায় দেন।
Download