একাত্তরের ভিন্নতর অবলোকন
একাত্তর নিয়ে ভাবনার তোলপাড় জাগানিয়া গ্রন্থ সংখ্যায় বেশি মেলে না, আমাদের সৌভাগ্য তেমন একটি উপহার মিলল হাসান ফেরদৌস প্রণীত ১৯৭১: বন্ধুর মুখ শত্রুর ছায়া গ্রন্থের সুবাদে। এ গ্রন্থের অবলম্বন একান্তভাবে বাইরের অবলোকন, ক্ষমতার বিভিন্ন বিশ্বকেন্দ্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসৃষ্ট অভিঘাত এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়েছে মূল বিবেচ্য। বিগত প্রায় এক দশকজুড়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধের বাছাইকৃত সংকলন এটি। বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ছোট-বড় বিভিন্ন রচনা মিলে গ্রন্থ আকারেও বেশ ভারিক্কি হয়েছে। তবে পাঠকের জন্য বড় পাওনা অনেক নতুন তথ্য ও বিশ্লেষণের নতুন দৃষ্টিকোণের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। ভারত, পাকিস্তান, চীন এবং সর্বোপরি আমেরিকা ও জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশ প্রশ্ন নিয়ে নানা বিবেচনা, বিভিন্ন পক্ষের অবস্থান, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে লেখকের বিবেচ্য। তবে এর অনেকটাই পর্দার অন্তরালের ছবি, যে চিত্র ধারণে প্রধান সূত্র হয়েছে সাম্প্রতিককালে অবমুক্ত বিভিন্ন গোপন দলিল, ইতিহাসের অংশীদারদের রচিত স্মৃতিভাষ্য, বিদেশে প্রকাশিত বইপত্র এবং সংবাদপত্রের রিপোর্ট। ফলে প্রচুর পাঠ নিতে হয়েছে লেখককে এবং তথ্যের জোগান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস-বিশ্লেষকের দায়ও তাঁকে মেটাতে হয়েছে। এমন রচনা কোনো সহজ কাজ নয়, তদুপরি অধিকাংশ নিবন্ধ রচিত হয়েছে দৈনিক সংবাদপত্রের চাহিদা ও পাঠকের দিকে লক্ষ রেখে। ফলে তাত্ক্ষণিকতার সঙ্গে মিশেল ঘটাতে হয়েছে ইতিহাস-চেতনার এবং এই কাজে হাসান ফেরদৌস রেখেছেন অনায়াস-দক্ষতার পরিচয়। অন্যদিকে এমনি দক্ষতা এক ধরনের সীমাবদ্ধতাও আরোপ করে। এ ধরনের রচনার একটি ঘাটতির দিক হলো, শেষ বিচারে তা আর হয়ে ওঠে না ইতিহাসের বই, হয় ইতিহাস-বিষয়ক বই, নিদেনপক্ষে রিপোর্টিং অন হিস্টরি। বিচ্ছিন্ন সব ফুল নিয়ে পূর্ণ এক মালা গাঁথার কাজটুকু থেকে যায় আরদ্ধ, পাঠককে তা করার মতো পুষ্পহার জোগান দিয়ে যান লেখক, মালা তিনি গাঁথেন না, তবে সেই পুষ্পাঞ্জলিও এক বড় পাওয়া বটে।