Ticker

6/recent/ticker-posts

জনতার জাগ্রত হৃদয়ে শওকত ওসমান

জনতার জাগ্রত হৃদয়ে শওকত ওসমান

মাহমুদুল বাসার


শওকত ওসমান দাবি করেছেন, তিনি লেখক নন, তিনি ‘ঝাড়-দার’। মানে? মানে হলো, সমাজে জমানো জঞ্জাল তিনি আমৃত্যু ঝাড়- দিয়ে সাফ করে যাবেন লেখার মাধ্যমে, তাই তিনি ঝাড়-দার। কী সাংঘাতিক কথা! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে বলতেন, কলম পেশা মজুর। শওকত ওসমানের রক্তের মধ্যে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-ঠাট্টা, ইয়ার্কি, উপহাস ঢুকে গিয়েছিল। এটাকে তিনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। সমাজের ক্লাউনদের, হিপোক্রেটদের, মৌলবাদী দৈত্যদের বুকে এই অস্ত্র তিনি নিক্ষেপ করতেন।

২ জানুয়ারি, শওকত ওসমানের জন্মতিথি। ১৯১৭ সালের এই দিনে তিনি পশ্চিমবঙ্গের সবল সিংহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম শেখ আজিজুর রহমান। শওকত ওসমান তার ছদ্মনাম। তার পিতার নাম ইয়াহিয়া, মায়ের নাম গুলজান বেগম। পিতা ছিলেন চাষী। শওকত ওসমানের কৈশোর কেটেছে ঘোর দারিদ্র্যের মধ্যে।

সবল সিংহপুর গ্রামের মক্তবে, পাঁচ বছর বয়সে তার শিক্ষা জীবন শুরু হয়। বছর দেড়েক পড়েছিলেন নন্দনপুর রূপচাঁদগুপ্ত একাডেমিতে। এরপর গ্রামের জুনিয়র মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। ১৯৩৩ সালের কলকাতা মাসাসা-এ-আলিয়ার ইংরেশি শাখা থেকে প্রথম বিভাগ পেয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মাদ্রাসায় পড়ার সময়ই শওকত ওসমান টিউশনি করে সংসারে টাকা পাঠাতেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি অর্থনৈতিকভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। তার রচিত ‘স্বগ্রাম স্বজন’ বইতে বাল্যকালের দারিদ্র্য ফুটিয়ে তুলেছেন।

১৯৩৪ সালে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। তখনও টিউশনি করেন। ১৯৩৬-এ এই কলেজ থেকে প্রথম বিভাগেই আইএ পাস করেন। মেধাবী ছাত্রছিলেন, তা তো বোঝাই যাইনি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে অনার্স ত্যাগ করে পাস কোর্সে পড়তে থাকেন। ১৯৩৯ সালে বিএ পাস করেন। ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী পেয়ে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্র জীবনেই ১৯৩৮ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম সালেহা খাতুন। শওকত ওসমান পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের বাবা ছিলেন। অকালে রবীন্দ্র-নজরুলের মতো তার একটি ছেলে মারা গিয়েছিল। নাম ছিল তুরহান ওসমান।

ড. আজাদ ঢাকা কলেজে শওকত ওসমানের ছাত্র ছিলেন। তিনি শওকত ওসমানের একটি অতুলনীয় সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সেটি গ্রন্থিত হয়েছে ‘সাক্ষাৎকার’ নামক বইতে। বইটি প্রকাশ করেছে আগামী, ১৯৯৪ সালে।

সেখানে ড. আজাদ শওকত ওসমানের যে চুম্বক মূল্যায়ন করেছেন, তাতেই এই দ্রোহী কথাশিল্পীর মৌলিক আদল প্রতিচিত্রিত হয়েছে। ড. আজাদ বলেছেন, ‘ক্রীতদাসের হাসির জন্য তিনি আদমজী পুরস্কার পেলেন। গর্বে গৌরবে উল্লাসে আমাদের বুক ভরে গেল। তাতারীর সেই মহান ঔদ্ধত্য ‘শোন, হারুনর রশীদ। দিরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দী কেনা সম্ভব। কিন্তু-কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি না-না-না’ তখন আমাদের রক্তে জ্বেলে দিয়েছে দ্রোহ।’

গুণীই গুণীর মর্যাদা বোঝে। ড. আজাদই মনে হয় শওকত ওসমানকে যথার্থ চিনেছিলেন। তাই তিনি স্মৃতি চারণায় বলেছেন যে, ‘তিনিই একমাত্র জ্ঞান বিলোতেন। চেষ্টা করতেন জ্ঞানের বিভিন্ন দরজা খুলে দিতে। আমরা ভিড় করতাম তার ক্লাসে। যদিও জানতাম তার কথা পরীক্ষার কোনো কাজেই লাগবে না। তবুও ভিড় করতাম। অথচ ওই আমরাই তো অন্য এক স্যারকে, যিনি ইসলামী পদ্য লিখে খ্যাতি আয় করেছিলেন পঞ্চাশের দশকে, মেঝে অবিরাম জুতো ঘষে কাঁদিয়েছিলাম। তিনি আর আমাদের ক্লাসে আসেননি কখনো। শওকত ওসমান বলতেন সভ্যতার কথা। সমাজের বিকাশের কথা। শিল্প কলার কথা। ... তিনি আমাদের গুরুত্ব দিতেন, কোমলমতি ভাবতেন না। জীবনের পাঠও দিতেন অনেক।’

ড. আজাদ জানিয়েছেন, ‘শওকত ওসমান’ নামটিই তাকে আকর্ষণ করেছে। এই নামের মধ্যেই আছে আধুনিকতা, আছে প্রগতির চিহ্ন। আমাদের সমাজে নাম দিয়েই কেবল বেহেস্ত পেতে চায় অনেকে, তাই নামে জড়িয়ে থাকে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস। শওকত ওসমান নাম দিয়েই দ্রোহ ঘোষণা করেন।

শওকত ওসমান দাড়ি রেখেছিলেন সময় বাঁচানোর জন্য, বলেছেন আজাদ। আর আবুল ফজল দাড়ি রেখেছিলেন পিতার অন্তিম অনুরোধে। আমার ধারণা, রবীন্দ্রনাথ দাড়ি রেখেছিলেন বাউল পরিচয় ফুটিয়ে তোলার জন্য।

ড. আজাদ বলেছেন, ‘তিনি আমাদের কাছে শিক্ষকের চেয়ে বড় ছিলেন। অন্য শিক্ষকদের মনে করতাম স্যার, শওকত ওসমানকে মনে করতাম আরো উচ্চ কিছু আরো মহৎ কিছু। তিনি শওকত ওসমান।’

ড. আজাদ জানিয়েছেন, শওকত ওসমানের ক্লাসে ঢোকার ঢংটি ছিল মনে রাখার মতো। পরনে ঢোলা প্যান্ট, উজ্জ্বল, রঙিন, আধহাতা ফ্লাইং শার্ট গায়ে। হাতে অপাঠ্য বই। ঢুকে, গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে বললেন, বুঝলেন স্যার, আমি আপনাদের ‘বিলাসী’ পড়াবো। আবার বললেন, ‘বুঝলেন স্যার, ওটা আমার পড়ানোর দরকার হবে না, ওটা আমার চেয়ে আপনারাই ভালো বুঝবেন।’

ড. আজাদ কবিতার ব্যঞ্জনার মতো করে বলেছেন, ‘শওকত ওসমান আমাদের দুবছর ‘বিলাসী’ পড়িয়েছেন। তিনি দুবছর কিছুই পড়াননি। পড়িয়েছেন অন্য স্যারেরা।’

শওকত ওসমান সম্পর্কে ড. আজাদের স্মৃতিচারণায় জড়িয়ে আছে বিপুল তাৎপর্য।

শওকত ওসমান দাবি করেছেন, তিনি লেখক নন, তিনি ‘ঝাড়ুদার’। মানে? মানে হলো, সমাজে জমানো জঞ্জাল তিনি আমৃত্যু ঝাড়ু দিয়ে সাফ করে যাবেন লেখার মাধ্যমে, তাই তিনি ঝাড়ুদার। কী সাংঘাতিক কথা! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে বলতেন, কলম পেশা মজুর।

শওকত ওসমানের রক্তের মধ্যে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-ঠাট্টা, ইয়ার্কি, উপহাস ঢুকে গিয়েছিল। এটাকে তিনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। সমাজের ক্লাউনদের, হিপোক্রেটদের, মৌলবাদী দৈত্যদের বুকে এই অস্ত্র তিনি নিক্ষেপ করতেন।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে, আশি বছরের আয়ু রেখায় দাঁড়িয়ে একটি দৈনিকে নিয়মিত পদ্য লিখতেন, নাম ‘শেখের সম্বরা’। তাতে সমকালের হিংস্র মৌলবাদীদের তিনি আঘাত করেছেন। পদ্য লিখতেন তিনি কবি যশ পাওয়ার লোভে নয়, বিদ্রূপ ঝলসানো তরবারি রূপে-মৌলবাদ সর্বস্ব অচলায়তন সমাজে বিদ্ধ করার জন্য।

শতাধিক গ্রন্থের স্রষ্টা তিনি। তাকে খ্যাতির শিখরে অধিষ্ঠিত করেছে ‘জননী’ ও ‘ক্রীতদাসের হাসি’। একেবারে শেষ জীবনে তিনি বাংলাদেশের একটি বড় মাপের পুরস্কার ‘ফিলিপস’ পেলেন ‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী’ গল্পগ্রন্থের জন্য। এছাড়া কোনো পুরস্কারই তার হাতছাড়া হয়নি, তা না বললেও চলে।

চাষীর সন্তান তিনি। নির্মম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন। এই দরিদ্র চাষী পরিবারেই জীবন্ত ছবি এসেছে তার প্রথম সার্থক উপন্যাস ‘জননী’তে। ‘জননী’ কিংবদন্তির খ্যাতি পেয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘জননী’ উপন্যাসে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী শহরতলির নিম্নবিত্ত মানুষের টানাপড়েনের চিত্র এঁকেছেন। শওকত ওসমান পূর্ববাংলার কৃষিভিত্তিক মহেশডাঙা গ্রামের ছবি এঁকেছেন।

শওকত ওসমানের ‘জননী’ই যেন অবিকল পূর্ববাংলা। এই উপন্যাসের নায়ক আলী আজহার খাঁ মামুলি চাষী। তার বসবাস খড়ের ঘরে।

শওকত ওসমানের গুরুত্বপূর্ণ কোনো একটি বই রাজনীতি সচেতনতার বাইরে পড়েনি। ‘বনী আদম’-এও ইংরেজ বিরোধিতার প্রসঙ্গ এসেছে। এসেছে সেক্যুলার সমাজের কথা, বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার।

‘জননী’ উপন্যাস ‘বনী আদম’ এর পরবর্তী ধাপ। এই উপন্যাসে শওকত ওসমান গ্রামবাংলার কাঠামোর অতলে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, যে ইহজাগতিক প্রবণতা গুপ্ত থাকে, তার জীবন্ত রূপ তুলে এনেছেন। আলী আজহার খাঁ, চন্দ্র কোটাল, দরিয়া, ইয়াকুব এরা বাংলাদেশের কৃষক সমাজের দরিদ্র মানুষ। এরা মানুষই আর কিছু নয়। তাই তারা জীবনের সংগ্রামে আমৃত্যু লড়ে যায়। হাতেম বকশ, রোহিনী চৌধুরীর মতো মতলববাজ জমিদাররা এদের মধ্যে বর্ণবাদের ফাটল ধরাতে পারে না।

ক্ষুধায়, দারিদ্র্যে, অনাহারে, কষ্টে, নির্যাতনে এরা আলাদা নয়, এক। যেন নদীর পানি কাটলে দুভাগ হয় না। ‘জননী’ উপন্যাসের আঙ্গিক পরিশীলনের গুরুত্ব না দিয়ে এর আড়ালের মহত্ব উপলব্ধি করতে হবে। জীবনের দাবি অপ্রতিরোধ্য : এটাই ‘জননী’ স্রষ্টার মরালিটি। জীবনকে ফাঁকি দেয়া যায় না। শুধু পেটের দায়ে নয়, মাতৃত্বের অনিবার্য প্রভাবে দরিয়া জঠরে অবৈধ সন্তান ধারণ করেছিল। মোনাদির তার আগের ঘরের ছেলে। তাকে মানুষ করার স্বপ্নতাড়িত হয়ে তাকে তার প্রতিনিধি রূপে সমাজে রেখে যাওয়ার দায়িত্ববোধ থেকে ইয়াকুবের কাছে ধরা দিতে হয়।

দরিয়াকে আমরা দেখবো সব ধরনের অচল সংস্কারের প্রথা চূর্ণ করে, জীবনের বিকাশের কাছে এগিয়ে যাওয়ার দুর্বার প্রতীক হিসেবে। জীবনের কুসুম ফুটিয়ে তুলে দরিয়া জীবন নিজ হাতে দান করে গেছে। তার আত্মহত্যাকে আত্মবিসর্জন বলাই শ্রেয়।

রাজনীতি ‘জননী’তেও এসেছে। উপমহাদেশে ওহাবীরা যে গোড়ামির জন্ম দিয়েছিল, তারই পরিণতি আলী আজহার খাঁ আর দরিয়ার পরিণতি। ভাত-কাপড়ের দাবি আগে একথা ফতোয়া দিয়ে ডাকা যায় না। তাই দরিয়া এবং চন্দ্রকোটাল একইসঙ্গে ধর্মকে ব্যঙ্গ করে।

‘ক্রীতদাসের হাসি’ শওকত ওসমানের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস। আর কোনো উপন্যাস না লিখলেও চলতো শওকত ওসমানের। ষাট দশকে উপন্যাসটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জ্বলন্ত প্রেরণা যুগিয়েছিল। খলিফা হারুনুর রশীদকে শওকত ওসমান আইয়ুব খানের আদলে দাঁড় করিয়েছিলেন।

স্বৈরাচারের নিকৃষ্ট, ঘৃণ্য, নিষ্ঠুর, বিকৃত পাশবিক চেহারা এ উপন্যাসে জীবন্ত রূপধারণ করেছে।

নিষ্ঠুর, অমানবিক প্রভুত্বও যে এক সময় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, স্বৈরাচারের সিংহাসনও যে এক সময় টলটলায়মান হতে পারে, তা শওকত ওসমান সার্থকভাবে দেখিয়েছেন।

ক্রীতদাস সে তো মানুষের বাইরের রূপ, খলিকাও বাইরের রূপ। মানুষ মানুষই। মানুষের মধ্যে থাকে মনসুর হেল্লাজের মতো অনির্বাণ বিদ্রোহী সত্তা। অত্যাচারের এক পর্যায়ে সেই ঘুমন্ত বিদ্রোহ অবাধ্য হয়ে ওঠে। শওকত ওসমানের তাতারী সেই বিদ্রোহী সত্তা।

‘হন্তারক’ উপন্যাসে শওকত ওসমান আবার চলে গেছেন মধ্য যুগে, সামন্ত শাসনের জমিনে। এঁকেছেন নির্দয়, শাসক আওরঙ্গজেবকে। আওরঙ্গজেবের হেরেমে নারীকে করা হয়েছিল বন্দিনী, তার ছিল না জীবন উপভোগের অধিকার। জীবনের দাবি অন্দরের মরুভূমিতে শুকিয়ে মরেছিল, শওকত ওসমান ‘হন্তারক’ উপন্যাসে এই প্রভুত্বের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গের কষাঘাত হেনেছেন। আওরঙ্গজেবকে তিনি স্বৈরাচারের প্রতীক রূপে অঙ্কন করেছেন।

শওকত ওসমান একেবারে গোড়া থেকে প্রখর সমাজ ও রাজনীতি সচেতন। তার দৃষ্টিতে যে মৌলবাদ বিরোধিতার দীপ্তি ছিল তা মৃত্যুর আগেও নেভেনি।

আমরা জানি, ১৯৪৬ সালে প্রতিক্রিয়াশীলরা বঙ্গ বিভাজনের যে নৃত্য শুরু করেছিল এর বিরুদ্ধে যে ক’জন বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন প-িত হুমায়ূন কবীর, সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ, বিপ্লবী কবি গোলাম কুদ্দুস এবং শওকত ওসমান।

অর্থাৎ শওকত ওসমান সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সার্বক্ষণিক এক যোদ্ধা। তাই দেখি যে, তার ‘রাজসাক্ষী’ উপন্যাসে আদম পাচারকারী এক ব্যক্তির আদালতে দুই পক্ষের আইনজীবীর জেরা উপলক্ষে টেনে আনেন ধর্ম রাষ্ট্রের কথা, টেনে আনেন পাকিস্তান নামক দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের কাহিনী। টেনে আনেন মওলানা মওদুদীর ১৯৫৩ সালে কাদিয়ানী হত্যার প্রসঙ্গ। বিচারপতি মুনীর ও বিচারপতি কায়ানী কাদিয়ানী বিরোধী আলেমদের মুসলমানের সংজ্ঞা দিতে বলেছিলেন। তারা এমন সংজ্ঞা দিয়েছিলেন যে, কারো সঙ্গে কারো মিল ছিল না, একজনের সংজ্ঞা মেনে নিলে অন্যজনকে খারিজ করতে হয়।

শওকত ওসমান ‘রাজসাক্ষী’ উপন্যাসেও কৌশল করে মৌলবাদ তথা সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরোধিতা করেছেন। সমাজ প্রগতির ছুরি দিয়ে গোড়ামিকে ফালা ফালা করেছেন। রক্ত-মাংসের বাস্তব জীবনকে চূড়ান্ত মূল্য দিয়েছেন।

শওকত ওসমানের একটি ব্যতিক্রমধর্মীগ্রন্থ ‘ভাব ভাষা ভাবনা’। অনেকেই বইটির খবর রাখেন না। জাতীয় গ্রন্থ ১৯৭৪ সালে বইটি প্রকাশ করেছে। ঔপন্যাসিক সর্দার জয়েনউদ্দীনের অনুরোধে ধারাবাহিকভাবে লেখাটি তৈরি করেছিলেন।

ভাষার ব্যবহার নিয়ে এখানে শওকত ওসমান ব্যঙ্গ নিপুণ কায়দায় অসামান্য পা-ত্িযের পরিচয় দিয়েছেন।

পুরো বিশ্লেষণ এখানে দেয়া সম্ভব নয়। শওকত ওসমান সাম্রাজ্যবাদী ভাষাতাত্ত্বিকদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে জোর দিয়ে বলেছেন, মানব সমাজই ভাষা বিকাশের চূড়ান্ত ক্ষেত্র এবং ভাষা উৎপত্তির গর্ভধারিণী হচ্ছে মনুষ্য সমাজ। বলেছেন শওকত ওসমান যে, মানুষের সামাজিক অভিজ্ঞতাই ভাবের বাহন হিসেবে ভাষায় প্রকাশ করা হয়। এ জন্য জরুরি প্রয়োজন হয় ভাষায় প্রতীক, উপমাতা, উৎপ্রেক্ষা ব্যবহারের।

শওকত ওসমানের এ বইটি না পড়লে বুঝতেই পারতাম না ভাষায় প্রতীক ও উপমা ব্যবহারের তাৎপর্য কোথায়।

এখানেও তিনি প্রাসঙ্গিকক্রমে সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরোধিতা করেছেন।

শওকত ওসমান প্রশ্ন করেছেন, যদি তর্ক বাধে, সংখ্যালঘুরা পূর্ণ নাগরিক অধিকার পাবে কি পাবে না, তার মীমাংসা কেমন করে প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিয়ে আইয়ার সাহেব দেবেন? শওকত ওসমান তাই বলেছেন ভাষা ব্যবহারে পরোক্ষ কৌশল সাংঘাতিক জিনিস, যার নাম প্রতীক ও উপমা।

১৯৮৫ সালে শওকত প্রকাশ করেন ‘ইতিহাসে’ বিস্তারিত নামক বইটি। যেন জ্বলন্ত বিদ্রোহের বারুদস্তূপ। শওকত ওসমান কী চিজ তা এ বই যারা পড়েননি, তারা বুঝবেন না। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এল-লাইকে খোলা চিঠি দিয়ে প্রশ্ন করেছেন, কেমন করে সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী হয়ে ইয়াহিয়ার মতো বর্বরকে সমর্থন করতে পারলেন?

‘মৌলবাদের আগুন নিয়ে খেলা’ শওকত ওসমানের একটি বিদ্রোহব্যঞ্জক সাড়া জাগানো গ্রন্থ। ধর্মান্ধ মৌলবাদের অন্তঃসারশূন্যতার নানাদিক এ বইতে বিশ্লেষিত হয়েছে। প্রশ্ন করেছেন, প্রতীক কোন ধর্মে না আছে? তাহলে এতা ঘৃণা কেন?

প্রশ্ন করেছেন, ধর্মে ধর্মে, কওমে কওমে মতপার্থক্য নেই? তাহলে হিন্দুদের প্রতি এতো বিরাগ কেন? প্রশ্ন করেছেন, ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্র, বিজ্ঞান, চিত্রকলা, ইতিহাস, চলচ্চিত্র চলে নাকি।

প্রশ্ন করেছেন, মওলানা মওদুদী ৭৫ বছর বয়সে আমেরিকার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করলেন কেন?

এ বইতে আলজিরিয়ার বিপ্লবী প্রেসিডেন্ট হুয়ারি ধুমেদিনের একটি বিবৃতি তুলে ধরেছেন ‘আক্কেল মন্ধ ইশারায় কাফি’দের উদ্দেশে : ‘আধ্যাত্মিক যোগসূত্র, হোক তা ইসলামী কি খ্রিস্টীয়’ কখনই দারিদ্র্য এবং অজ্ঞতার দাঁত কিড়মিড়ানির বিরুদ্ধে তেমন দাঁড়ায়নি। আমি বলতে চাই যে, মানুষ যদি ভুখা থাকে তার পবিত্র আয়াত শোনা দরকার নেই। এ কথা আমি বলছি, পবিত্র কোরআনের প্রতি সব শ্রদ্ধা রেখেই যে পবিত্র কেতাব আমি দশ বছর বয়সেই শিক্ষা করেছি। ভুখা মানুষের দরকার রুটি, অজ্ঞ লোকের দরকার জ্ঞান এবং অসুস্থজনের দরকার হাসপাতাল। ... খালিপেটে লোক বেহেশতে যেতে চায় না পুরো সমস্যার মূল কথা এখানে নিহিত। ... মসজিদ যদি ব্যবহৃত হয় অবিচার, শোষণ, দাসত্ব এবং সামন্ততন্ত্র রক্ষায়, তাহলে তা ইসলামের মসজিদ নয়। তা হবে ইসলাম ধ্বংসের মসজিদ।’

(মৌলবাদের আগুন নিয়ে খেলা, পৃ. ৩৪)।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ওই বিখ্যাত ‘খালেদ’ কবিতার অংশটুকুও প্রাসঙ্গিকক্রমে ব্যবহার করেছেন : বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা এখনো বসে। বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকা ও হাদিস চষে।’

আজকের এই যুদ্ধাপরাধী আলবদরদের দাঁতাল বৈরী সময়ের দুঃসহ যন্ত্রণার দিনে শওকত ওসমানের মতো অনির্বাণ প্রমিথিউসকে অবনতচিত্তে স্মরণ করছি।


Post a Comment

0 Comments