Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

প্রজাপতি - সমরেশ বসু

amarboi প্রজাপতি - সমরেশ বসু

অশ্লীলতার ফাঁদে পড়ল 'প্রজাপতি'। ১৮ বছর বন্ধ রইল উড়াল। এর লেখক সমরেশ বসু তাঁর লেখালেখির শুরু থেকেই নারী-পুরুষের সংরাগ-সংসক্তির বিচিত্র চিত্রকর। তাঁর 'উত্তরঙ্গ', 'সওদাগর', 'শ্রীমতি কাফে' থেকে শুরু করে 'বিবর' পর্যন্ত ওই প্রবণতা দিনে দিনে কেবল স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে। কিন্তু সমরেশ বসু কেবল এ বিষয়টিকে উপজীব্য করেননি। নইলে দিব্যেন্দু পালিত বলতেন না, "এই একজন : যাঁর মধ্যে একত্র হয়েছিল তারাশঙ্করের 'অভিজ্ঞতা', বিভূতিভূষণের 'অনুভূতিপ্রবণতা', মানিকের 'প্রশ্ন', সতীনাথের 'পটভূমিজনিত ভিন্নতা'। বাংলা গল্প-উপন্যসের বিপুল ভারসম্পন্ন ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ গুণগুলোর সমন্বয় ঘটিয়ে সমরেশ বসু হয়ে ওঠার জন্য তাঁকে যুক্ত করতে হয়েছিল নিজের সময় ও মানসিকতা, নিজস্ব ভাষা ও ভঙ্গি_সাহস, স্পষ্টবাদিতা এবং একের মধ্যে বহু। হতে হয়েছে কালকূট।" ('এক ধরনের আশ্রয়', দেশ, ১৪ মে ১৯৮৮)। কালকূট মানে তীব্র বিষ। এটি তাঁর ছদ্মনাম। 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে', 'কোথায় পাব তারে'সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন। কিন্তু নিজের সেই তীব্র বিষ তিনি প্রয়োগ করেছেন 'বিবর', 'প্রজাপতি', 'প্রকৃতি'র মতো উপন্যাসে সমরেশ বসু নামে। 'প্রজাপতি' ১৩৭৪ সালে শারদীয় দেশ-এ প্রকাশিত হয়। একে অশ্লীল হিসেবে শনাক্ত করে নিষিদ্ধ করার আবেদন করে ১৯৬৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মামলা করলেন এক তরুণ অ্যাডভোকেট অমল মিত্র। আবেদনকারী তাঁর পক্ষে ৮ জন সাক্ষীর নাম দেন। এর ভেতর ৭ম সাক্ষী হিসেবে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও ছিল এবং ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্যের নাম। দুইজনের কেউই তাঁর পক্ষে সাক্ষী দিতে আসেননি। আসামি হিসেবে ছিলেন সমরেশ বসু এবং দেশ-এর প্রকাশক ও মুদ্রাকর সীতাংশুকুমার দাশগুপ্ত। এবং সমরেশের পক্ষে সাক্ষী হিসেবে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, নরেশ গুহের মতো ব্যক্তিরা। কলকাতা চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বাদীপক্ষের অভিযোগের ও সাক্ষ্যের সারকথা হলো, প্রজাপতি অশ্লীল, সাহিত্যের পবিত্রতা নষ্টকারী এবং এ উপন্যাস পড়ে কোমলমতি কিশোর-কিশোরীরা গোল্লায় যাচ্ছে। এবং যুবকেরা ইন্দ্রিয়শক্তির কথায় ভরপুর এই উপন্যাস পড়ে তাদের সুকুমারবৃত্তি হারিয়ে ফেলেছে। ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সে ছেলেমেয়েরা লাইন দিয়ে দেশ-এর ওই শারদীয় সংখ্যাটি কিনেছে। সাহিত্যে মাধুর্য, নৈতিক শক্তি উজ্জীবনী বৈশিষ্ট্যের স্থলে 'প্রজাপতি'র মতো রচনা কামনার জোগান দিয়েছে মাত্র। এর সামাজিক ও সাহিত্যমূল্য কোনোটাই নেই। অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসুর মতে, তিনি এতে পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক বাস্তবতার ছবিই পেয়েছেন। এর ভেতরে অশ্লীল বলে কোনো কিছুই তাঁর চোখে পড়েনি। আর সাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীলতার নিক্তি কোথায়? তাহলে রামায়ণ-মহাভারতসহ মহা মহা গ্রন্থের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উঠতে পারে। এর নায়ক ও এখানে উপস্থাপিত নারী-পুরুষ এবং তাদের কর্মকাণ্ডে যে নষ্টামি তা সময়েরই ছবিমাত্র। এই ছবি বাস্তবসম্মত। লেখক এর মাধ্যমে সমাজের ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিয়েছেন। নরেশ গুহও প্রায় বুদ্ধদেব বসুরই প্রতিধ্বনি করেন। এখানে ব্যবহৃত শব্দাবলী আগে কখনো ব্যবহার হয়নি প্রসঙ্গে বলেন, রবীন্দ্রনাথও অনেক শব্দ ব্যবহার করছেন, যা তাঁর আগে কেউ কখনো ব্যবহার করেননি। সমরেশ বসু তার লিখিত বিবৃতিতে এ উপন্যাসের গঠন, চরিত্র চিত্রণ এবং তার নায়ক সুখেনের জীবন ও তাঁর কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, 'বাবার দুর্নীতি, দাদাদের দলীয় রাজনীতিকে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার করা_সব সুখেনের মনকে তিক্ত করে তোলে। সে বেখাপ্পা হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে অবাধ্য। জীবন সম্পর্কে বীতস্পৃহ। এ উপন্যাস তাঁর জীবনের শেষ চবি্বশ ঘণ্টার কাহিনী।' ...তার মতে, কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক লোক সুখেনের মতো মাস্তান চরিত্র দিয়ে প্রভাবিত হতে পারে না। বরঞ্চ যাদের বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তারা সাবধান হবে। 'প্রজাপতি' নিষিদ্ধ করার মামলার রায় বাদীর পক্ষে যায়। ১১ ডিসেম্বর, ১৯৬৮ সালে রায় ঘোষণা করা হয়: উপন্যাসটি অশ্লীল এবং একে নিষিদ্ধ করতে হবে। মজার ব্যাপার হলো, দিনটি ছিল সমরেশ বসুর জন্মদিন। এতে বলা হয়, 'উপন্যাসটিকে অশ্লীল বলে ঘোষণা করার পর তার লেখক সমরেশ বসুকে কোনো মতেই অব্যাহতি দেয়া যায় না। তা তিনি যত বড় লেখকই হোন না কেন?_এই মন্তব্যসহ আমি তাঁর আলোচ্য উপন্যাসকে (প্রজাপতি) অশ্লীল ঘোষণা করছি। তাকে সাজাও দিচ্ছি। ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯২ ধারা অনুযায়ী তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করছি। ২০১ টাকা জরিমানা অনাদায়ে দুই মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিচ্ছি। এবং প্রকাশককেও একই সাজা দেয়া হয়। এবং দেশ শারদীয় সংখ্যার (১৩৭৪) ১৭৪ থেকে ২২৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত নষ্ট করে দেয়ার জন্য বলা হয়। রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে জরিমানার টাকা জমা দেয়া হয়। এবং মামলা হাইকোর্টে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কলকাতা হাইকোর্টও ব্যাঙ্কসাল কোর্টের রায়ই বহাল রাখে। এসব ঘটে ১৯৭৩ সালে। হাইকোর্টে বিচারপতি মামলাটিকে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার অনুমতিও নাকচ করে দেন। কিন্তু হাল ছাড়েন না সমরেশ বসু ও দেশ কর্তৃপক্ষ। মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে ওঠে ১৯৭৯ সালে। ১৯৮০ সালে প্রজাপতির অনুবাদ চাওয়া হয়। অনুবাদের কাজে সময় ১৯৮২ সালে পেঁৗছায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনুবাদটি আগুনে নষ্ট হওয়ায় ১৯৮৫ সালে আবার অনুবাদ পেশ করা হয়। শুনানি চলে ২০, ২২ ও ২৩ আগস্ট, ১৯৮৫ সালে। রায় প্রকাশিত হয় এক মাস পর ১৯৮৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, প্রজাপতি অশ্লীল নয়। এবং অভিযুক্তদের অভিযোগমুক্ত করা হলো। সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি ১২ বছর ধরে ছিল। রায় ঘোষণা হলে সাগরময় ঘোষ একে ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করেন। বাংলা সাহিত্যের কোনো উপন্যাস নিয়ে ১৭ বছর ধরে আইনি লড়াই এই প্রথম। বারবার ডিএইচ লরেন্সের 'লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার'-এর কথা এসেছে। সাহিত্যের অশ্লীলতার সীমা নিয়েও কথাবার্তা হয়েছে। অনেক আড্ডা, বৈঠক, আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে 'প্রজাপতি' ও সমরেশ বসু। অথচ কী ছিল এই উপন্যাসে? এর নায়ক সুখেন। তারই জবানে কাহিনীটা বলা। তার এই বয়ান মাত্র ২৪ ঘণ্টার, কিন্তু এতেই তুলে আনা হয়েছে সুখেনের গোটা জীবন। নানা ঘটনা, কথাবার্তা আগুপিছু করে বারবার দেখানো হয়েছে। বয়ানের সূচনা একটা প্রজাপতি ধরার কাহিনী। ধরতে গিয়ে ভেসে উঠেছে জিনা নামের একটা মেয়ের কথা। এর সঙ্গে জড়িয়ে আমরা জানি শিখার কথা। শিখাকে সুখেন বিয়ে করে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল। সে হতে চেয়েছিল শিক্ষক। দুর্নীতিপরায়ণ বাবা, বেল্লেলাপনার হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয়া মা, বড় দুই ভাইয়ের রাজনীতি ও স্বার্থসিদ্ধিসহ নানা পাঁকচক্রে পড়ে সুখেনের আর কিছু করা হয় না। মাস্তানি হয়ে ওঠে সময় কাটানোর ও বেঁচে থাকার উপায়। কায়েমি স্বার্থবাদী লোকজন, সমাজের তথাকথিত অভিজাতেরা তাকে ব্যবহার করে। সেও সুযোগ নেয় ভোগ-বিলাসের। এবং একটি দুর্ঘটনা দিয়ে ইতি টানা হয় এ কাহিনীর। নারীদেহের বর্ণনা কিছু থাকলেও নারী-পুরুষের তুমুল কোনো সঙ্গম দৃশ্যের বর্ণনা পর্যন্ত এতে নেই। যেটুকু আছে তা আভাসে ইঙ্গিতেই আছে। এ উপন্যাসে ব্যবহৃত শব্দাবলী তুলে আনা হয়েছে কলকাতার রকবাজদের সেই সময়ের প্রচলিত কথাবার্তা থেকে। সমরেশ বিষয়টি চিন্তা করেছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি গল্প পড়ে। সেখানে নিজের জবানে একজন সমাজবিরোধী গুণ্ডা_সে যে মন্ত্রীর পোষ্য ছিল তাকে দোষারোপ করে অনেক অভিযোগ করছে। সমরেশের মনে হলো, সে যে ভাষায় নিজের কথা বলছে তা রীতিমতো সভ্য, শিক্ষিত মানুষের ভাষা, এতে তার বয়ান কৃত্রিম হয়ে উঠেছে। সমরেশ সেই চিন্তা থেকে একজন লম্পট ও বখে যাওয়া ব্যক্তির জবানেই তাঁর নিজের কাহিনী তুলে আনতে চাইলেন। লেখা হলো 'প্রজাপতি'। 'প্রজাপতি' অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হলে সেই দায়ভার দেশ পত্রিকার সেই সময়ের সম্পাদক অশোককুমার সরকার নিজের ওপরেই নিয়েছিলেন। তাদের আমন্ত্রণে লেখক লিখেছেন, তাঁরা সে লেখা ছেপেছেন, এটা যদি অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয় তার দায়িত্ব তাদেরই। আর সমরেশ ২ নভেম্বর, ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত নিষেধাজ্ঞার দায়মুক্ত 'প্রজাপতি'র ভূমিকার ইতি টেনেছেন ফরাসি সাহিত্যিকের একটি মন্তব্যের কথা মনে করিয়ে দিয়ে। পাঠককে জিজ্ঞাসাকাতর করতে চেয়েছেন_শহরের রাস্তায় আবর্জনার ছবিসহ প্রতিবেদন ছাপা হলে সেজন্য ওই প্রতিবেদক ও ফটোগ্রাফারকে যদি কেউ আক্রমণ করে_তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? ১২ মার্চ, ১৯৮৮ সালে সমরেশের মৃত্যু হয়। বলতে দ্বিধা নেই, বাংলা সাহিত্যে সমরেশের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। বালজাক যা করেছেন ফরাসি সাহিত্যের জন্য, বাংলা গল্প-উপন্যাসে সমরেশ বসুর কাজ সেই ভূমিকায় দেখে নেয়া যেতে পারে। সমরেশের চরিত্ররা উঠে এসেছে পুঁজিবাদের বিকার ও এর শিকারে পরিণত হওয়া দুই শ্রেণী থেকে। সঙ্গে জড়িয়ে গেছে দেশ, রাজনীতি, ইতিহাস ও জীবনরহস্য_কী নয়! বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে নিত্য ও আমৃত্যু ক্রিয়াশীল লেখকের নাম সমরেশ বসু। দেবেশ রায় তাঁর মৃত্যুতে লেখা রচনাটির শিরোনামই দিয়েছিলেন, 'জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লেখক এবং পেশাদার লেখক' (প্রতিক্ষণ, ৫ম বর্ষ, ১৭ সংখ্যা, ২-১৬ এপ্রিল ১৯৮৮)। লিখেছিলেন, 'তিনি আমাদের মতো অফিস-পালানো কেরানি লেখক ছিলেন না_যাঁদের সাহস নেই লেখাকে জীবিকা করার অথচ ষোল আনার ওপর আঠারো আনা শখ আছে লেখক হওয়ার।' আর লেখক হিসেবে সমরেশ আমৃত্যু যে লড়াই করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। তাঁর নিজের জীবনই আরেক মহাকাব্যিক উপন্যাস। 'চিরসখা' নামের বোধ করি ৫ লাখ শব্দের বিশাল উপন্যাসে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তারই পুত্র নবকুমার বসু। সেই লড়াই ভালোবাসাকে বুকে নিয়ে সমস্ত অসুন্দর ও অশ্লীলতার বিরুদ্ধে লড়াই। সেই লড়াইয়ে 'প্রজাপতি'র উড়াল বাংলা সাহিত্যের জন্য বিরাট ঘটনা হলেও সমরেশ জীবন ও শিল্পের কাছে বোধ করি ততটা বড় কোনো কিছু নয়। মহামান্য পাঠক, নিশ্চয়ই লক্ষ করে থাকবেন, 'প্রজাপতি'র উড়ালের পর সমরেশ বসু মাত্র তিন বছর বেঁচেছিলেন।

Download and Comments/Join our Facebook Group