Ticker

6/recent/ticker-posts

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০ থেকে ১৯৭১ - ডঃ মোহাম্মদ হাননান

History of Student Movement in Bangladesh 1830 - 1971 by Mohammed Hannan Ph.D.বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০ থেকে ১৯৭১ - ডঃ মোহাম্মদ হাননান।
বিশ শতকের বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের প্রধানতম ঘটনা কি, সে বিষয়ে হয়তো নানারকম বিতর্ক ও প্রশ্নই উঠবে। কিন্তু এই শতকে কারা ছিল এ দেশের প্রধান নিয়ামক শক্তি, সে প্রশ্নে সম্ভবতঃ একটাই উত্তর আসবে—ছাত্ররা। বস্তুতঃ এদেশের ছাত্ররা এবং একমাত্র ছাত্ররাই ছিল বিশ শতকে বাংলা ও বাঙালির জীবনে প্রধানতম ঘটনা।

যদিও উনিশ শতকের গোড়া থেকেই আধুনিক বাঙালির যাত্রা শুরু, তথাপি উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ছাত্ররা একটি শক্তি হিসেবে বাংলার সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছি। এই সূত্র যোগেই বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস রচনা ১৮৩০ সাল মাইলস্টোন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

কিন্তু তখনো পর্যন্ত আধুনিক অর্থে ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেনি। হিতকারী কর্মকাণ্ড, কল্যাণ সমিতি ইত্যাদির মধ্যেই ছাত্রদের কর্মকাণ্ড সীমিত ছিল, যদিও উনিশ শতকের প্রথমার্দ্ধ থেকেই ‘ইয়ংবেঙ্গল’ ছাত্রসমাজ সামাজিক বিদ্রোহের সূচনা করে রেখেছিল। ১৮৪০ সালে যখন বৃটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিল বাংলার সকল জেলাতে একটি করে সরকারী কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হবে, একমাত্র তখনই কলকাতার বাইরে সারা বাংলায় ছাত্র সমাজের সংগঠিত কর্মকাণ্ড জেগে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

তবে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ, বিশেষ করে নব উত্থিত বাংলার মুসলমান ছাত্র সমাজের জন্যে ১৯২১ সালের একটি ঘটনা ছিল অপেক্ষিত। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা শুধুমাত্র পূর্ব বাংলা অঞ্চলের মুসলমান ছাত্রদের জন্যে নয়, এ অঞ্চলের সমগ্র মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের জন্যেও তা গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন কেউই হয়তো ভাবতে পারে নি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজই একদিন বাঙালির স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রধান ভূমিকা পালন করবে।

বৃটিশ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর পাকিস্তানের কাঠামোতে এ দেশে ছাত্র সমাজ একটি সংগঠিত শক্তি হিসেবে সমগ্র রাজনৈতিক ইতিহাসকেই নিয়ন্ত্রণ করেছে। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ছাত্ররাই ছিল একমাত্র আপোষহীন শক্তি। গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় ছাত্রদের এখনো বিকল্প নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অন্যান্য জাতীয় সংকটকালে জনগণের কাছে পাশাপাশি ছাত্ররা তাদের শিক্ষার সংগ্রামকেও উচ্চকিত করে তুলেছ। আজ বাংলাদেশের শিক্ষার হার যে ৫৬% অর্জন করেছে এটা ছাত্রদের, বলতে গেলে একমাত্র ছাত্রদেরই কৃতিত্ব। কারণ ‘শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার’ এই শ্লোগান সকলের আগে। এদেশের ছাত্ররাই প্রথম উচ্চকিত করে তুলেছিল।

ফলে দুনিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় একমাত্র বাংলাদেশের ছাত্ররাই তাদের স্বতন্ত্র ভূমিকাকে জাতির কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। আর এই একটি মাত্র কারণেই বাংলাদেশের ছাত্রদের নিয়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শেষ নেই। এই ষড়যন্ত্রের একটি বড় সফলতা জনগণ থেকে ছাত্রদের দিন দিন বিচ্ছিন্ন করে তোলা, ছাত্রদের ঘাড়ে সন্ত্রাসের দায়ভাগ তুলে দেওয়া এবং পরীক্ষায় দুর্নীতির কলঙ্ক লেপন করা। ১৮৩০ সালে বাংলার ছাত্র সমাজ দেশে ও জাতির প্রতি অসীম দায়িত্ব নিয়ে যে মহাযাত্রা শুরু করেছিল, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তার একটা সফল পরিণতি আসায় ছাত্রদের ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও তারা ভুলে যেতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের পর দুই-দুইটি সামরিক শাসন ছাত্রদের আবার রাজপথে নিয়ে আসে। বাংলাদেশের ছাত্রদের এই গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের ইতিহাস রচনায় ড. মোহাম্মদ হাননান পথিকৃৎ। তিনি প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র ইতিহাসকার, যিনি ছাত্রদের এই গাঁথাকে ১৮৩০ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত একটি ফ্রেমে এই গ্রন্থে তুলে ধরেছেন।

ড. হাননান রচিত ১৯৮৪ সালে প্রথম এই ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস রচনার সূত্রপাত করেছিলেন। এ পর্যন্ত ছাত্রদের ইতিহাসের পাঁচটি খণ্ড আলাদা আলাদাভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

পাঠকদের বিশাল চাহিদার মুখে বিভিন্ন খণ্ডের কয়েকটি সংস্করণের পর ১৮৩০ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ছাত্রদের ইতিহাসের কাহিনী একটি খণ্ডে এই গ্রন্থে সংযুক্ত করা হয়েছে। বৃহৎ কলেবরের এই সংস্করণ একুশ শতকের নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে এক আলাদা অভিধায় চিহ্নিত হবে, ইতিহাসের আলোকে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র রাজনীতিও নতুন প্রজন্মের কাছে তার কর্তব্যকে স্থির করতে সক্ষম হবে।

যতোদিন পর্যন্ত গণতন্ত্র এদেশে স্থায়ীভাবে মুক্তি না পাবে, ততোদিন হয়তো ছাত্রদের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই, যদিও একুশ শতকের নতুন পৃথিবী বাংলদেশের ছাত্র সমাজের কাছে নতুন কর্তব্য ও দায়িত্বকে উপস্থিত করতে চায়। এদেশের প্রতিটি মানুষ শিক্ষার অধিকার ভোগ করবে, গণতন্ত্রের অভিযাত্রা অক্ষুণ্ন থাকবে, সামরিক শাসন আর জনগণের কাঁধে চড়ে বসবে না, পবিত্র ধর্মের বিকৃত ব্যবহার হবে না, ধর্ম মুক্তি লাভ করবে রাজনৈতিক ব্যবসায়ীদের হাত থেকে—একুশ শতকের বাংলাদেশ এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়েই শুধু এদেশের ছাত্রদের ঘরে ফেরাতে পারবে।

ড. মোহাম্মদ হাননান, দেশের শিকড় অনুসন্ধানী তরুণ গবেষক, যিনি বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের সেই গৌরব গাঁথাকে এক বিরল প্রতিভার গুণে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। দেশের ছাত্র সমাজের কাছে তাদের নিজেদের ইতিহাসের এই মহাকাব্য এক দুর্লভ সংগ্রহ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।