Ticker

6/recent/ticker-posts

হুমায়ূনের মতো মানুষ আর হয় না - এইচ এম মনিরুজ্জামান

হুমায়ূনের মতো মানুষ আর হয় না
এইচ এম মনিরুজ্জামানএমন দিন যায় না, তার কথা আমার মনে পড়ে না। জুন মাস এলেই বেশি কুঁকড়ে ওঠে হৃদয়। কিছুদিন আগে একটা পত্রিকা পড়ছিলাম; পড়তে গিয়েই দেখি তার ছবি ও লেখা। সাধারণত আমি আগে মূল পত্রিকা দেখি। কিন্তু ওই দিন সব কিছু বাদ দিয়ে তার ওপর লেখাটাই পড়তে শুরু করেছি আগে। একটা বই পড়ব, দেখা গেল যে হুমায়ূনের বইটিই আবার হাতের কাছে চলে আসে, আবার পড়তে শুরু করি। বলতে পারি, কোনো না কোনোভাবে হুমায়ূন চলে আসে। যেমন তার নাটকে অনেকে কাজ করেছেন, আমিও করেছি। চ্যালেঞ্জার তার নাটকে কাজ করে বিখ্যাত হয়েছে। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে যেমন করিম, মাজহার ও কমলকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছে হুমায়ূন। মাহফুজ প্রথম আবিষ্কৃত হয় তার নাটকে অভিনয় করে। আরো আছেন আসাদুজ্জামান নূর। তার স্কুলজীবনের বন্ধু ছিলেন ড. করিম। হুমায়ূন খুব লাজুক স্বভাবের ছিল। কেউ যদি এগিয়ে যেত হুমায়ূনের দিকে, তাহলে হুমায়ূন হাতটা বাড়িয়ে দিত। আমার সঙ্গে তার দেখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে। আমি বয়স ও পড়াশোনার দিক থেকে তার দুই বছরের সিনিয়র ছিলাম। কাজেই আমাকে ভাই বলে ডাকত। আমি থাকতাম ছয়তলায় এবং হুমায়ূন থাকত পাঁচতলায় ঠিক আমার নিচের রুমে। তখন ১৯৬৭-৬৮ সাল। তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশ ছিল ভালো এবং ছাত্রসংখ্যা পাঁচ-ছয় হাজারের মতো হবে। তখন জুনিয়ররা সিনিয়রদের সমীহ করত। সিনিয়রদেরও আমরা সম্মান করতাম। সব মেধাবী ছাত্রই এ ব্লকটাতে থাকত। সে সময় আসা-যাওয়া-দেখা- এভাবেই চলতে থাকে। নানা রকম কাণ্ড করত বিভিন্ন সময়। সে ম্যাজিক দেখাতে পারত। সে হিপনোটিজম বা সম্মোহন করতে জানত। মুহসীন হলে থাকার সময় একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে। একটি ছেলে এসে তাকে বলল, আপনি নাকি খুব ম্যাজিকট্যাজিক দেখান! আপনি নাকি সম্মোহনও করতে পারেন? হুমায়ূন বলল, না না, কে বলছে? ছেলেটি বলল, না না, দেখি। হুমায়ূন সত্যি সত্যি যেটুক ছিল তার জানা, সেটুকু তার ওপর প্রয়োগ করল এবং ছেলেটি একেবারে ফ্রিজ হয়ে গেল। হুমায়ূন তো হতভম্ভ। তাকে তো আর সে নরমাল করতে পারছে না। সব ছেলেমেয়ে এসে হৈচৈ শুরু করে দিল। তারপর প্রোভস্ট এলেন। তখন ওই ছেলেকে বাধ্য হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলো। এ রকম অনেক ঘটনা হুমায়ূন ঘটিয়েছে। এর ফলে সে হলে পরিচিত হয়ে গেল। আমাদের মধ্যে আলমগীর, কমল, মনির, করিমের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। আর নাটক যারা করত, তাদের মধ্যে আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। একপর্যায়ে হুমায়ুন আজাদের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আজাদ নিঃসন্দেহে অনেক গুণী মানুষ ছিলেন। কিন্তু একটা সময় হুমায়ূনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কিছুটা টানাপড়েন ঘটে। এরপর শাকুর মজিদ ও প্রকাশক মাজহারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশকদের নিয়ে পার্টির আয়োজন করত হুমায়ূন। এটা নিয়ে নানাজন নানা কথা বলত। কিন্তু হুমায়ূন বলত, আমি তো একটা কলম দিয়ে কাগজে লিখি। আর ওই লেখা যারা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়, তারা তো প্রকাশক। কাজেই তারা আমার অনেক ভালো বন্ধু। তার সঙ্গে আমি সারা বাংলাদেশ ঘুরেছি। বলতে পারি, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ঘুরেছি। শহীদুল্লাহ হলে থাকার সময় সে একটা ছোট গাড়ি কেনে, তাতে চারজন যেতেই কষ্ট হতো। তার মধ্যে দেখা গেল ছয়-সাতজন নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে গেল। তারপর হুমায়ূন কিনল একটা মাইক্রোবাস। নতুন নতুন প্রবলেম তাকে তৈরি করতেই হবে। বেড়ানো তার অনেক পছন্দ। হুমায়ূন কখনো নির্বোধ মানুষ পছন্দ করত না। সে পছন্দ করত একটু বুদ্ধিমান ও মেধাবী মানুষকে; তার লেখায় নারী চরিত্রকে সে যেমন বলত রূপবতী নারী, সৌন্দর্যমণ্ডিত নারীর কথা। মূলত সে পছন্দ করত মেধাবীদের, ভালো ছাত্রছাত্রীদের। নিজে খুব মেধাবী ছাত্র ছিল বলেই এই গুণটা যাদের মধ্যে দেখত, তাদেরই সে পছন্দ করত। খাবারের ব্যাপারে হুমায়ূন যার খাওয়া সবচেয়ে বেশি পছন্দ করত সেটা নিঃসন্দেহে আমার স্ত্রী। এখন তো অনেকেই অনেক কথা বলে। হুমায়ূন ওকে ডাকত খালা বলে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার সময় হুমায়ূনের সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়। আরো পরে সে তো পাঁচ বছরের জন্য চলে যায় আমেরিকায়। হঠাৎ করে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেয়। একদিন সে আনন্দমোহন কলেজে এক্সটারনাল হয়ে গেল পরীক্ষা নিতে ১৯৮৪ সালে। সেখানে আমার সঙ্গে দেখা হলো। আমি তাকে তখন বাসায় নিয়ে আসি। হুমায়ূন বিয়ে করেছে আমাদের আগে। হঠাৎ করে আমার স্ত্রী তাহমিনা মুনীরকে দেখে তো অবাক। সে বলল, খালা! হুমায়ূন যখন চাকরি করত, তখন ও কলেজে পড়ে। তখন থেকেই আমার স্ত্রীকে খালা বলে ডাকত। বলল, মনির ভাই, আপনি এখানে কেন? ময়মনসিংহ সে আসত বেড়াতে কিংবা ঘুরতে। সবার সম্পর্কে তার একটা মূল্যায়ন ছিল। যেমন সে আমাকে বলত, আমি নাকি সেইফ সাইড! মানে আমার কাছে কোনো কথা বললে তা আর কারো কানে যাবে না। হুমায়ূনকে যদি বলা হতো, তোমার কাছে এই কথাটা বললাম, কারো কাছে বলা যাবে না। সে কিন্তু একমূহুর্ত দেরি না করে বলে ফেলত। কারণ তার পেটে কথা থাকত না। সে বন্ধুত্বকে কতটা গুরুত্ব দিত, তা বলে বোঝানো যাবে না। আমি একমাত্র ব্যক্তি আমাদের পরিবারে, আমি শুধু ময়মনসিংহে থাকতাম। আমার মা-বাবা সবাই ঢাকায় থাকতেন। ঢাকায় আসতাম নিয়মিত। একবার হুমায়ূনের সঙ্গে দেখা হলে সে আর ছাড়ত না আমাকে। শহীদুল্লাহ হলে থাকার সময় এলিফ্যান্ট রোডে একটি দশতলা বাড়ির আট নম্বর তলা কেনে হুমায়ূন। সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা এই যে হুমায়ূন এলিফ্যান্ট রোডে বাড়ি কেনার পর একদিন রাত সাড়ে ১১টার সময় পৌঁছে গেল। সে আমার স্ত্রীকে বলল, খালা, আধা ঘণ্টার ভেতর রেডি হতে হবে। ও ডাকত মামা। রাত ২টার সময় রওনা হলাম ঢাকায়। সুন্দর করে সে সাজিয়ে রেখেছে তার বাড়িটি। সে বলল, প্রথম রাত আমরা এখানে থাকব; তারপর হুমায়ূন এ বাড়িতে থাকবে। আমার প্রতি হুমায়ূনের ভালোবাসা বা হুমায়ূনের প্রতি আমার ভালোবাসার এ ছিল এক বিশাল ব্যাপ্তি ও প্রাপ্তি। এ কথা মনে উঠলে এখনো কান্না চেপে রাখতে পারি না। গুলতেকিন খাবার নিয়ে এলো। সারা রাত কেটে গেল। একবার আমরা সেন্ট মার্টিনে যাব। তো, আমরা একদিন টেকনাফে থাকলাম। সেখান থেকে যাব। কিন্তু তখন ছিল চার নম্বর সতর্কতাসংকেত। কিন্তু সে মানল না কোনো বাধা। সে ঝড়ের মধ্যেই রওনা দিল। হুমায়ূনের ছিল সততা, সাহস ও আদর্শ, যেটা অন্য অনেক মানুষের ভেতর আমি প্রবলভাবে দেখিনি। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারব, সে ছিল সৎ। তার মতো এ রকম মানুষ আর হয় না।
অনুলিখন : শ্যামল চন্দ্র নাথ

Post a Comment

0 Comments