Ticker

6/recent/ticker-posts

শ্রাবণ মেঘের দিন - শাকুর মজিদ

humayun ahmed
২৪ জুলাই ২০১২।
আজ আমার বাবার মৃত্যু তারিখ। ১৯৮৫ সালের এই তারিখে ভোরবেলা আমার সামনেই আমার বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছিল। তিনি জাহাজে চাকুরী করতেন। অসুখ ধরা পড়ে মাল্টায়। সেখান থেকে অস্ট্রোলিয়া হয়ে তাকে ফেরত পাঠানো হয় দেশে। প্রায় ১৮ মাস নানাভাবে বেঁচে ছিলেন। সে অনেক কাহিনী। আমার বয়স তখন ১৯-২০ এর মতো। সংসারের বড় ছেলে। কত চাপ।

বাবার মৃত্যুর দিনটা আমার খুব মনে পড়ে। সেদিন সকালটা খুব ঝকঝকে ছিলো। দুপুরের পর পরই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি এলো। জোহরের নামাজের পর গ্রামের লোকগুলো তাঁকে নিয়ে আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে কবর দিল।

আমার সবচেয়ে ছোট ভাইটির (রাসেল) বয়স তখন ৫ বছর ছিল। বাবার লাশকে যখন সাদা কাপড়ে মোড়া হচ্ছিলো, সে বারবার বলছিলো, বাবাকে এরকম কাপড় পরানো হচ্ছে কেনো? তার আরো অনেক প্রশ্ন ছিলো। যেমন বাবাকে ওরা নিয়ে গেলো কেনো? বাবা আসছে না কেনো? এসব।

আমার মনে আছে, বাবাকে কবরে নামানো হচ্ছে, আমি পাশে দাঁড়িয়ে। কেউ একজন আমাকে বললেন, নীচে নামতে। আমি নামি না, ভয় পাই। বাবাকে শোয়ানো হলো, একজন আমাকে বললেন, প্রথম মাটির ঢেলাটা যেনো আমি দেই।

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমার মাথার উপর যেনো ছাতা ধরে রেখেছে। কিন্তু আমি ভিজে আছি আমার সারা শরীরে কাদা মাখানো। আমি একটুকরা কাদা ছুড়ে মারলাম বাঁশের মাচার উপরে। তারপর বাবার লাশ ধীরে ধীরে আমার কাছে অদৃশ্য হয়ে গেলো, আর কখনো দেখা হয়নি। ছুটি ছাটায় বাড়ি গেলে দূর থেকে দাঁড়িয়ে কবর জিয়ারত করি। এইটুকুই।

গ্রামের বাড়িতে আমার মা থাকেন প্রায় একা। তার বড় ছেলে হিসেবে আমি থাকি ঢাকায়। দুই ছেলে বিলেত, এক মেয়ে আমেরিকায়, আরেক মেয়ে আছে বিয়ানী বাজারে।
জুলাই মাস এলেই বিদেশে থাকা আমার ভাই-বোনেরা বেশ অস্থির হয়ে যায়। বিশেষ করে আমেরিকায় থাকা আমার ছোট বোন নুরু। বাবার মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হবে ২৪ তারিখে, মসজিদে শিরনী যাবে, বাড়িতে মৌলানারা এসে খতম পড়বে, কবর জিয়ারত হবে। এসবের আয়োজন চলতে থাকে।
এ বছর আমার সবচেয়ে ছোট ভাই দেশে আছে। কিছুদিন আগে তার বিয়ে হয়েছে। তার বউর লন্ডন চলে যাবার কথা। কিন্তু নতুন পরিবারে এসে শ্বশুড়ের মৃত্যুবার্ষিকী সামনে রেখে সেও লন্ডন যাচ্ছে না, ২৪ তারিখের পর যাবে। এ বছর মৃত্যুবার্ষিকীটা অনেক বড় করে আয়োজন করবে তারা। তারা চাইছে আমিও যেনো সেদিন উপস্থিত থাকি।

অথচ আমি অবাক হয়ে দেখি, ১৯ জুলাইর পর তারা কেউই আমাকে এ বিষয়ে কোনো কিছু জানায় না। এমনকি আজ ঢাকার বারডেমের হিমঘর থেকে তাঁর লাশ নিয়ে এখানে এই নুহাশপল্লীতে আসা পর্যন্ত আমি নিজেও বাড়িতে ফোন করে কোন খোঁজ নেইনি।

২৩ জুলাই ভোর বেলা তাঁর লাশ এসে পৌছে ঢাকায়। সেখন থেকে শহীদ মিনারের নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলীর শেষে তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হয় হিম ঘরে। লাশ কোথায় দাফন হবে এ নিয়ে ফায়সালা হতে সময় লাগে প্রায় ১৫ ঘন্টা। মধ্যরাতে সিদ্ধান্ত হয় লাশ দাফন হবে এই নুহাশপল্লীতেই লীচু গাছের তলায়। সকাল সাড়ে ন’টায় লাশবাহী গাড়িটি ঢাকা থেকে রওয়ানা দেয়। পৌঁছে এসে দুপুর বারোটার দিকে।

আজও সেই ১৯৮৫ সালের মতো দেখি অবস্থা। সকালটা ফকফকা ছিলো, তিনি এসে ঢুকতেই আকাশ ফাটিয়ে ঝরে পড়লো শ্রাবণ মেঘের ধারা।

পিরুজালী বাজারের মোড় থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার পথের প্রায় পুরোটুকুই গাড়িতে ঠাসা। এ সড়ক এর আগে কখনো দেখেনি এমন গাড়ির স্রোত। নুহাশপল্লীর মাঠের সবুজ নরম ঘাসের ডগায় এতো শত পায়ের ছাপও না।

বৃষ্টি মধ্যেই ৩-৪টি টেলিভিশন অনলাইন ব্রডকাস্টি শুরু করেছে তার দাফনের প্রক্রিয়ার। লীচু তলায় শুরু হয়েছে কবরের জন্য। সব কিছু একা সামলাচ্ছেন প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী, শাওনের বাবা।
আরেকটা ছোট শামিয়ানার নীচে রাখা হয়েছে তার কফিন।

এক সময় দেখি, নয় নম্বর বিপদ সংকেত এর চিত্রনাট্যের যেনো বাস্তব রূপ নিয়ে তার কফিনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর পুত্র-কন্যারা। হায়রে নিয়তি!

বাপের প্রতি নির্মম অভিমানে যে কন্যারা তার জীবদ্দশায় এই নুহাশপল্লীর চত্বর থেকে দূরে ছিলেন তারা এখন সামিল হয়েছেন শবযাত্রার বিদায়ী আয়োজনে। সিনেমার মতো যদি এখন কফিন খুলে বেরিয়ে এসে হুমায়ূন বলতেন- এই, আমি কিন্তু মৃত্যুর অভিনয় করলাম। মরিনি, দেখলাম- আমার মৃত্যুর পর তোমরা কে কী করবে তার জন্য এই মৃত্যু-মৃত্যু খেলাটা খেলেছিলাম মাত্র। আসো, আমার ঘরে আসো, বসো। এই কুসুম, তুমি একটু রেস্ট নাও, আমি আমার মেয়েদের সাথে একটু গল্প করবো, আর আমার স্যুটকেসটা দাও তো, নিউইয়র্ক থেকে আমার নাতি-নাতনির জন্য যে কাপড়গুলো কিনেছি, ওটা বের করো।

এমন তো তিনি শুরু করেছিলেন ১৯৯৫-৯৬ সালে, সেই ‘আজ রবিবার’ থেকে। ‘আজ রবিবার’- এ বৃদ্ধ পিতা তার কবরের ডিজাইন করিয়েছিল, পাগলা মামা কফিনের ভেতর শুয়ে কবরের স্বাদ নিয়েছিল। তার ১৫-১৬ বছর পর যখন এই নুহাশপল্লীকে নিয়েই ছবি বানালেন ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’- তখনও কিন্তু সেই চিন্তারই প্রকাশ ঘটালেন। মাঝখানে তাঁর নিজের চরিত্রটা নিয়ে এলেন।

সিনেমা বা নাটকের কাহিনী বদল হয়ে যায় নিমেষে। মানুষ আরো কতগুলো মানুষকে নিয়ে অনেক নাটকীয় ঘটনার জন্ম দেয়, মৃত্যু দেয়। সে যা চায় তাই পারে। কিন্তু এই বিশ্ব নাট্যমঞ্চে আমাদের মতো তুচ্ছ মানুষকে নিয়ে যে নাট্যকার-নির্দেশক নাটক সাজিয়েছেন তার নির্দেশকে অবজ্ঞা করবে এমন সাধ্য কোন নটের? যদি তাই হতো, তাহলে এই ডেথ সিনকে ইমপ্রোভাইজ করে কফিন থেকে বেরিয়ে আসা হয়তো কোনো ব্যাপারই ছিলোনা।

পৃথিবীর এই রঙ্গমঞ্চে হুমায়ূন আহমেদ নামক যে চরিত্রের আবির্ভাব ঘটেছিল ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার এক গ্রামে, এই চরিত্রের সমাপ্তি ঘটে গেছে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই নিউইয়র্কে। চরিত্রের সমাপ্তি ঘটলেও মঞ্চ থেকে নিষ্ক্রান্ত হবার জন্য তার এক্সিট পয়েন্ট ঠিক করে রেখেছেন এই নাট্য পরিচালক। তার জন্য রেখেছেন এই নুহাশপল্লীর সবুজ চত্বর।

১৯৮৫ সালে আমার উনিশ-কুড়ি বছর বয়স, আমার সাহস ছিলো না বাবার কফিন নিয়ে গোরস্থানে যেতে। আমি লাশের বহরের সাথে ছিলাম। এবার বয়স হয়েছে, কিঞ্চিত সাহসও। অনেকের সাথে আমার কাঁধও ছিলো কফিনের করালে।

কবরের পাশে এসে কফিন নামানো হয়। ওপাশে নুহাশ দাঁড়িয়ে। নুহাশের এখন যা বয়স, ১৯৮৫ সালে আমার বয়স অনেকটা সে রকমই ছিলো। নুহাশ কী করবে সে জানে না। একজন বললো-নুহাশ, তুমি নামো। সে সময় আমি কিন্তু সাহস পাইনি, নুহাশ পেয়েছে। কাদামাখা কবরের গর্তে নেমে গেলো নুহাশ।

এবার লাশ কবরে নামানোর পালা। তাঁর পা যেদিকে আছে, আমি সেপাশে দাঁড়ানো।
লাশ নামানোর জন্য ওটাকে হাত দিয়ে ধরতে হয়। আমি এই জীবনে কোনো লাশ ছুঁইনি। আজ ছোঁব। আমি, অনেকের সাথেই একটা পা ধরলাম। ডীপ ফ্রিজের ভেতর থেকে লম্বা মাছ বের করে আনলে ওটাকে যে রকম শীতল-শক্ত মনে হয়, পা’টাও দেখি সে রকম। হিমঘরে থেকে পুরো শরীরটা হিমায়িত।

তারপরের প্রক্রিয়াগুলো খুবই স্বাভাবিক। আমি বারবার নুহাশকে দেখি এবং ২৭ বছর আগের আমাকে দেখি।

বৃষ্টি থেমে যায় এক সময় । ধীরে ধীরে মানুষের স্রোতেও ভাটা পড়ে। নুহাশপল্লীর সবুজ ঘাসের চত্বর কাদার প্রলেপে ঢেকে যায়। অনেক দূরে একটা গাছের তলায় বসে থাকি।
আমার মা’র ফোন আসে। বলেন, চিন্তা করিস না, মিলাদের সব ব্যবস্থা ঠিক আছে। আজ তোর বাবার জন্য দোয়ার সময় একসাথে হুমায়ূন আহমেদের জন্য দোয়া হবে।

২৭ বছর আগে বাবাকে কবর দিয়ে এসে পুকুর পাড়ে বসেছিলাম। আমার কান্না আসেনি। আজ বসে আছি সেই জাপানী বটের তলায়। আমার কি কান্না আসছে এখন? আমি ঠিক বলতে পারবো না।
এই জগৎ নাটের নাটশালার নটবর তার তৈরি নট-নটিদের নিয়ে কখন কী আসর সাজান আমরা বুঝতে পারিনা।

Post a Comment

0 Comments