রাগ দরবারী
শ্রীলাল শুক্লা
অনুবাদ
রমেন মজুমদার
ভূমিকা
হিন্দী উপন্যাসের ইতিহাস উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে আরম্ভ । কিন্তু তার এক গম্ভীর এবং সুস্পষ্ট রূপ ফুটে উঠেছে প্রেমচন্দের আগমনের পর থেকে । এটা আশ্চর্যের বিষয় হতে পারে যে, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দশকগুলিতে পাশ্চাত্য জগৎ যখন তাদের উপন্যাস সাহিত্যের উন্নতির চরম শিখরে উঠেছে তখন হিন্দী উপন্যাস তার শৈশবের অবোধ ঔপন্যাসিক চরিত্র থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করছে । প্রেমচন্দের রচনা কয়েক বছরের মধ্যেই উপন্যাস-সাহিত্যে নতুন মহিমা স্থাপন করল আর হিন্দী উপন্যাসকে সমকক্ষতার মর্যাদা দিয়ে তাকে শ্রেষ্ঠ উপন্যাস-জগতের মানচিত্রে অঙ্কিত করে দিল ।
বিংশ শতাব্দী রাজনৈতিক বিপ্লব, সাংস্কৃতিক সংক্রমণ এবং মানুষের অদৃষ্টের ওপর প্রশ্ন চিহ্ন বসানের শতাব্দী। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি শিল্পসংস্কৃতিকে কেবল নিরর্থক প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লাগে নি, তাকে এক বিরাট ঢালেঞ্জের সামনে এনে দাড় করিয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিবিদ্যার চ্যালেঞ্জের সামনে উপন্যাস সেই একই রকম ভাবে দাড়িয়ে আছে । উপন্যাসের অতিকল্পনাকে বিজ্ঞান বাস্তব রূপ দিয়েছে, কিন্তু মানুষের আকাঙ্ক্ষার অক্ষয় ভাণ্ডার এখন নিঃশেষ। প্রযুক্তিবিদ্যার সামনে মানুষের ক্রমক্ষীয়মাণ বিশ্বাস আর তার সমগ্র বিরূপতার কথা উপন্যাসে চিত্রিত হচ্ছে । ঐ একই তীব্রতার সঙ্গে আমাদের আজকের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের নরকও আধুনিক উপন্যাসের বিষয হয়েছে। হিন্দী উপন্যাস সাহিত্যের প্রসঙ্গে এ কথা বলা অতিশয়োক্তি হবে না যে, মানুষের জীবনের যেসব দিক কোনো মহিমান্বিত ভাষার সাফল্য বলে পরিগণিত হয় তার চিত্রও এতে সম্যকরূপে আছে। হিন্দী উপন্যাসের ইতিহাস যদিও খুব পুরনো নয়, তবু তার সাফল্যের পরিধি বিরাট ।
প্রেমচন্দের যুগের আগেকার উপন্যাস অলৌকিক ঘটনা আর ঐতিহাসিক চমৎকারিত্বে ভরা । তাদের অসাফল্যের সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ তারা কোনো ঐতিহ্য রেখে যেতে পারে নি। ভাষা আর শিল্পগত স্তরে ঐসব উপন্যাসের কোনো দান নেই । প্রেমচন্দই প্রথম সামাজিক চেতনার সেইসব বিন্দু ধরার চেষ্টা করলেন, যাতে সামাজিক পরিবর্তন, স্বাধীনতা, রূঢ় এবং মরণাসন্ন মূল্যবোধের বিরোধিতা ও অন্যান্য সমস্যার মোকাবিলায় মানুষের সংগ্রামের কথা স্থান পেয়েছে। প্রেমচন্দের ‘গোদান’ উপন্যাস এমন এক মূল্যবান প্রস্তরখণ্ড, যেখান থেকে আধুনিক হিন্দী উপন্যাসের যুগের সূত্রপাত। গোদানে একজন চাষীর মজুর হয়ে যাবার তরণগাথা চিত্রিত হয়েছে । এই চিত্রের সাহায্যে প্রেমচন্দ মহাজনী অর্থাৎ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ওপর আঘাত হানতে চেয়েছেন এবং বলতে চেয়েছেন, চাষী থেকে মজুরে রূপান্তরিত হবার এই ট্র্যাজিডি নগরীকরণের ভয়াবহ ভূমিকার একটা প্রমাণ। নগর আর গ্রামের দুই ভিন্ন বিন্দুকে স্পর্শ করছে এই যে কাহিনী, এ আমাদের বর্তমানকালের এক ঐতিহাসিক দলিল । প্রেমচন্দ আর তার সমকালীন অধিকাংশ লেখক “সামাজিক ন্যায়”-কেই তাদের উপন্যাসের উপজীব্য করেছেন । লোকজীবনের বিবিধ দৃশ্যে সম্পূরিত প্রেমচন্দকালীন উপন্যাসে লোক-সংস্কৃতির সেইসব প্রারূপ বর্তমান, যাতে দাসত্ব থেকে মুক্তি, চাষী-মজুরদের আর্থিক সংঘর্ষ আর ভারতীয় সমাজে একটা ন্যায়পরায়ণ সমাজবাদ আনার সংকল্পের মহিমান্বিত সক্রিয়তা চিত্রিত হয়েছে। সারা পৃথিবীতে ফ্যাসিজম, বিশ্বযুদ্ধ আর সাম্রাজ্যবাদী মনোবৃত্তি যে আতঙ্কের আবহাওয়া সৃষ্টি করেছিল, হিন্দী উপন্যাসে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে আজও তার সংগ্রথিত রূপ খুঁজে পাওয়া যাবে গণ-আন্দোলনের যথার্থতা থেকে সৃষ্ট এক রাষ্ট্রীয় মানসিকতার এই উপন্যাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর “মাতুম”-কে কেন্দ্র করে “ব্যক্তি’-র অন্তর্জগতের কথার উপন্যাস কী করে হ’ল, সে এক মনোজ্ঞ কাহিনী হতে পারে, কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সামাজিক পটভূমিতে ব্যক্তির নিজস্ব জগতের চিত্রাঙ্কন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয় । বস্তুতপক্ষে, “ব্যক্তি”-র বিশ্লেষণের এই ধারা “ব্যক্তির অন্বেষণে”-র ধারা । অজ্ঞেয়, জৈনেন্দ্র, ইলাচন্দ্র যোশী, গবর্তীকরণ বর্ম প্রভৃতি লেখকের উপন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে যশপাল, অশক, অমৃতলাল নাগর, বৃন্দাবনলাল বর্ম প্রভৃতি ঔপন্যাসিকের রচনা প্রকৃত অর্থে ভারতীয় জনজীবনের বিবিধ সংস্কৃতি-ক্ষেত্রের কাহিনী বর্ণনা করছে ।
স্বাধীনতা এমন এক কেন্দ্রবিন্দু যাকে ভিত্তি করে স্বাধীনতা-পূর্ব তথা স্বাধীনতার পরবর্তীকালের উপন্যাসের আলোচনা করা যেতে পারে । হিন্দী উপন্যাসে সামাজিক ন্যায়বিচার আর মনোবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগের পর একেবারে নতুন একটা ভূমির স্পর্শ পাওয়া গেল স্বাধীনতার পরে । নতুন রচয়িতারা ভারতীয় রাজনীতি আর স্বাধীনতার পরবর্তীকালের ভারতের স্বরূপকে সত্যিকারের পরিপ্রেক্ষিতে চিত্রিত করায় সফল হলেন । মোহন রাকেশ, ফণীশ্বরনাথ রেণু, কৃষ্ণবলদেব বৈদ, নাগাৰ্জুন, ভৈরবপ্রসাদ গুপ্ত, কমলেশ্বর, রাজেন্দ্র যাদব, রাঙ্গেয় রাধব, নরেশ মেহতা প্রভৃতির উপন্যাসকে এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। রেণুর ‘ময়লা আঁচল’ আর নাগাৰ্জুনের ‘বলচনমা’ এমন রচনা, যাতে প্রেমচন্দ-কালীন সামাজিক ন্যায়বিচারের মানসিকতার প্রস্ফুট রূপ চিত্রিত হয়েছে এবং সংবেদনশীলতার ভিত্তির ওপর আধুনিক ভারতীয় লোকানুভব ব্যঞ্জিত হয়েছে । এইসব উপন্যাসের মধ্যে অনেকগুলিই আমাদের আজকের যুগের “ক্লাসিক উপন্যাস” হয়ে গেছে। এটা বিস্ময়ের কথা যে, আধুনিক রচনা আধুনিক কালেই ক্লাসিক রচনা হয়ে গেছে। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, কেবল বস্তুচেতনার দৃষ্টি থেকেই নয়, শৈল্পিক আর সংবেদনের দৃষ্টি থেকেও স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগের কতকগুলি উপন্যাস ‘উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যমুলক প্রকাশভঙ্গি’ নতুন করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতার কয়েক বছর পরে তরুণ লেখকদের যে নতুন প্রজন্ম সামনে এসেছেন তারাও এমন কতকগুলি উপন্যাস লিখেছেন যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে । এইসব উপন্যাস আকারে ছোটো, কিন্তু আজকের সত্যকে বোঝার জন্য এগুলো একপ্রকার প্রমাণ হয়ে দাড়িয়েছে । শ্রীকান্ত বৰ্মা, শ্রীলাল শুক্ল, রমেশ বকসী, মহেন্দ্র ভল্লা প্রভৃতি লেখকের উপন্যাসে সমকালীন “বিরূপতা” তার সমগ্রতার মধ্যে চিত্রিত হয়েছে। আমাদের সামাজিক জীবনে যা কিছু আছে, তার শৈল্পিক ব্যাখ্যা এই কারণে কোনো মাধ্যমেই সম্ভব নয় যে, আজ যা কিছু আছে তা এক বিকট রকমের “ধ্বংসের” অংশ মাত্র । ব্যক্তি, পরিবার, জাতি, ব্যবস্থা, সংস্থা, বিশ্বাস আর অনাগত ভবিষ্যতের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে তাকে খেয়ালী কিংবা বিদ্রোহী অথবা নৈরাশ্যপূর্ণ আখ্যা দেওয়া যায় না। বরং বলতে হবে, এটা এমন একটা বিকল্পহীন স্থিতি, যাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা যায় । বস্তুত, এমন কতকগুলি উপন্যাস আছে, যা ঐ “নিশ্চিহ্ন” করার ভূমিকা গ্রহণ করেছে। স্বাধীনতার পরে গণতন্ত্রের প্রয়োগে নিরত রাজনীতি কতদূর পর্যন্ত আমাদের সাংস্কৃতিক সংক্রমণকে অধিকতর সংকটময় করে তুলেছে তা এক অদ্ভুত ব্যাপার হলেও ভয়ংকর। সমকালীন ঔপন্যাসিকেরা এই ট্র্যাজিডিকেই তাদের উপন্যাসের লক্ষ্য করেছেন । স্বাধীনতাপূর্ব যুগের ঔপন্যাসিকেরা যেভাবে সমাজ আর মানুষের অন্তর-মনের সমস্যাবলীর সহানুভূতিপূর্ণ চিত্র এ কেছেন, নতুন কথা-সাহিত্যিকের সেই রীতি ত্যাগ করে নিজেদের সামাজিক স্থিতির সামনে রেখে আসলে সমাজের ধ্বংসোন্মুখ আস্থাগুলোকে অনাবৃত করে দিয়েছেন । ‘জাহাজ কা পঞ্ছী”-র তুলনা ‘অন্ধেরে বন্ধ কমরে’-র সঙ্গে হতে পারে না । সম্ভবত, কোনো স্তরেই কোনো দুটো উপন্যাসের তুলনা হতে পারে না । কেবল সুবিধার জন্য এ কথা বলা যেতে পারে যে, দুটো উপন্যাসে দুটাে ভিন্ন দৃষ্টি কাজ করে । এই দৃষ্টি বা মানসিকতা একরকম ভাবে উপন্যাসের মূলাধারের নিয়ামক । অতএব স্বাধীনতার পরে লেখা হলেও দুটো উপন্যাসের দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য থাকতে পারে । তাই যখন কোনো উপন্যাসে আমরা মানবীয় স্তরে “ব্যক্তি”-র অন্তর্জগতের চিত্র পাই আর অন্য একটা উপন্যাসে নিজের সত্যটাকে দেখে সেই ভয়ংকরের মানবীয় রূপ পাই তখন দুটো উপন্যাসের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার সেই সূত্রটা খুঁজে নিই, যেটা পূর্ববর্তী উপন্যাস থেকে আজকের উপন্যাসকে আলাদা করছে ।
‘গোদান’ থেকে ‘রাগ দরবারী’ পর্যন্ত যাত্রাপথে এইরকম অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস আছে। সেগুলো যেমন ক্লাসিকের গরিমায় মণ্ডিত তেমনি আধুনিক উপন্যাসের শ্রেণীভুক্ত প্রয়োগধর্মী উপন্যাস । ‘গোদান’ আর ‘রাগ দরবারী’-র মধ্যে রচনাধর্মের কোনো সাম্য না থাকতে পারে, কিন্তু ভারতীয় জীবনের দুই গুরুত্বপূর্ণ “বিন্দু”-র এবং দুই সাংস্কৃতিক দৃষ্টির অস্তিত্ব দুটো উপন্যাসেই আছে। প্রেমচন্দ অপেক্ষাকৃত বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, সাহিত্যজগতে র্তার স্বীকৃতি “রাগ দরবারী-র লেখক শ্ৰীলাল শুক্লার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। শ্রীলাল শুক্ল আধুনিক লেখকদের সেই শ্রেণীর অন্তর্গত, যারা মূলত তাদের প্রয়োগধর্মী রচনাকার্যের দ্বারা সাহিত্যক্ষেত্রে স্থান করে নিয়েছেন । ‘রাগ দরবারী’ রচনার আগে শ্রীলাল শুক্লা হিন্দী সাহিত্যজগতে একজন ব্যঙ্গ-লেখক বলে পরিচিত ছিলেন । হঠাৎ "রাগ দরবারী’ উপন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে তিনি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস-লেখক হিসাবে হাজির হলেন । এখানে বলা দরকার যে, ব্যঙ্গ লেখক হিসেবে শ্রীলাল শুক্লার ব্যঙ্গ রচনায়, বিশেষ করে তার ‘অঙ্গদ কা পাঁও’ সংকলন-গ্রন্থে, যে “গাম্ভীর্য” পাওয়া যায়, তার উপন্যাসেও সেই গাম্ভীর্য পরিলক্ষিত হয়— যদিও কয়েকজন আলোচক “রাগ দরবারী’-কে ব্যঙ্গ-রচনার একটা সংকলন-গ্ৰন্থ মাত্র বলেছেন । সুতরাং "গোদান’ আর ‘রাগ দরবারী’ বস্তুতপক্ষে গম্ভীর রচনা। এই দুটি উপন্যাস এমন দুজন লেখকের সৃষ্টি যাদের রচনা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করা যায় না । এটা কৌতুহলের বিষয় যে, যেখানে ‘গোদানে গ্রাম থেকে শহরে যাবার কথা ব্যক্ত হয়েছে, নগরীকরণের প্রক্রিয়ার ভীতিপ্রদ সত্য বণিত হয়েছে, সেখানে ‘রাগ দরবারী’-তে শহর থেকে গ্রামের দিকে প্রয়াণ । স্বাধীনতার আগে শহরীকরণের অন্ধ প্রতিযোগিতায় “শহরের” গুরুত্ব ছিল, সেই গুরুত্ব আজ কমে যায় নি— কিন্তু রাজনৈতিক নীতি থেকে বাচার জন্য এবং অন্য শহরের চাপ থেকে বাঁচার জন্য গ্রামের দিকে যাবার যে সূত্র আছে তা আজকের ভারতের আসল স্বরূপ উদঘাটন করছে। “গ্রাম” আর “শহর” ভারতের গণজাগরণের এবং সংস্কৃতির দুই কেন্দ্র। এখানে জীবনের স্পন্দনে সমস্ত রকমের বিভিন্নতা আছে, কিন্তু গণতন্ত্রীকরণের ফলে যে সংস্কার দেখা দিয়েছে তা কমবেশি এক। গ্রামের মতো ছোট্ট একটা শহর— সেখানে গ্রামীণ উত্তেজনা জাতীয় প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বড়ো শহর এবং মহানগরের মতো রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপও সেখানে একই রকম সক্রিয় । ‘রাগ দরবারী’-র এই সত্য তার শিরোনাম থেকেও প্রতিধ্বনিত হয় । ছোটে। শহর আর বড়ো শহরে রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে নতুন স্বভাবকে প্রকাশ করছে তা অনেক দিক দিয়ে এক নতুন ধরনের সামন্ততান্ত্রিক আচার-আচরণকে প্রশ্রয় দিচ্ছে । ‘রাগ দরবারী”-র ব্যঙ্গ কাহিনীর চাবুক পড়েছে এই আচার-আচরণের উপর যা কেবল অমানবীয় নয়, বরং অত্যন্ত বিশ্রী, বিরক্তিকর আর অসহনীয়।
কথাশিল্পের বিবিধ শৈলীর নতুন নতুন আর নানারকম প্রয়োগ আর ভাষাগত মাধুর্যে ‘রাগ দরবারা’ কোনো ক্লাসিক উপন্যাসের চেয়ে কম নয়। কিন্তু তাই বলে একে সোজাসুজি আধুনিক ক্লাসিক উপন্যাস বলা ঠিক হবে না। এ ভয়ংকরের এক সার্থক ব্যঙ্গ । একদিক দিয়ে এ আপন “ব্যবস্থা’-র গোটা খেলাটার মধ্যে থেকেও তাকে অস্বীকার করা । স্বয়ং নিজে থেকেও থাকাটাকে নষ্ট করে দেওয়া একটা ভালো রচনার লক্ষ্য হতে পারে, কিন্তু এখানে আমার উদ্দেশ্য 'রাগ দরবারী’ র সদগুণগুলো বিচার করা নয়। যদিও শিল্পের দৃষ্টিতে “রাগ দরবারী’-র কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি নেই (কারণ তথাকথিত শৈল্পিক দৃষ্টিতে “হীন” কোনো শিল্পহীন রচনাও শ্রেষ্ঠ হতে পারে ) অথবা অন্য ভিত্তিতে কোথাও কোথাও দুর্বল মনে হতে পারে, তবু সংবেদনের আধারে আমাদের সামাজিক বিশ্বাসঘাতকতা, ধূর্ততা আর প্রবঞ্চনাকে উন্মুক্ত করে দেবার ক্ষেত্রে এ এক সৎ প্রচেষ্টা ।
একজন সমালোচক “রাগ দরবারী”-কে আঞ্চলিক উপন্যাসের শেষ কৃতি বলে আখ্যাত করেছেন । আমি জানি না, আঞ্চলিক উপন্যাসের আরম্ভ তিনি কোথা থেকে ধরেছেন। তবে এটুকু অবশ্যই বলা যেতে পারে যে, “রাগ দরবারী’ এক সার্থক ব্যঙ্গ রচনার আরম্ভ । এতে বেঢপ ব্যঙ্গ প্রসঙ্গও আছে, কিন্তু সমস্ত ব্যঙ্গ প্রসঙ্গই তার বাহ্যিক অর্থে কুরূপ হয়ে থাকে । সমস্ত আঘাত আর তর্কের ভাষায় আক্রমণ থাকে আর সমস্ত আক্রমণেই এক রক্তরঞ্জিত কুরূপতার আরম্ভ থাকে । আজকের ভাষায় যাকে বিরোধ বা বিদ্রোহ বলা হচ্ছে,
ব্যঙ্গের ভাষায় তাকে সহস্থতি বলে তার ভেতরকার অর্থ-স্বার্থের বনিয়াদ ভেঙে দেওয়া হয়, তাকে তার সঠিক পদ-অর্থের সংগীতে দেখার ও চেনার চেষ্টা করা হয় । একটি ব্যঙ্গ-কথাশিল্প হিসাবে "রাগ দরবারী’-র সাফল্য নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু এই উপন্যাস নিঃসন্দেহে এক ভয়াবহ অথচ প্রত্যক্ষ ব্যঙ্গকৃতি । এর এক নিজস্ব দৃষ্টিকোণ আছে। তবে এ কথা বলা যেতে পারে যে, তা বোঝার জন্য হয়তো আলাদা পথও আছে । সম্ভবত এই উপন্যাস “কুতির পথ” দিয়ে দেখার সুযোগে ভরা উপন্যাস, এবং তা হয়তো এই কারণে যে, এ একটা উপন্যাস আর সেইসঙ্গে ব্যঙ্গও । সমাজ-ব্যবস্থার বীভৎসতা, রাজনীতির ঘৃণ্য নষ্টামি— এসব প্রকাশ করার কাজ খবরের কাগজও করতে পারে । এই দিক দিয়েও ‘রাগ দরবারী’ আর খবরের কাগজের তৎকালীনতায় পার্থক্য আছে । খবরের কাগজ শিল্পকর্ম হয় না, কিন্তু “রাগ দরবারী” একটা শিল্পকর্ম। আর শিল্পকর্ম হবার প্রথম শর্ত এই যে, তাকে বিতর্কমূলক হতে হবে, সমস্তরকম সন্দেহে ভরা। এবং এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে, “রাগ দরবারী” কেবল বিতর্কমূলক উপন্যাস নয়, এ “সন্দেহে”রও কেন্দ্রবিন্দু।
গঙ্গাপ্রসাদ বিমল
Download and Comments/Join our Facebook Group