Ticker

6/recent/ticker-posts

সোনালি ডানার চিল - সুরঞ্জন প্রামাণিক

amarboi
সোনালি ডানার চিল
লেখক: সুরঞ্জন প্রামাণিক

‘সোনালি ডানার চিল’ কথাটির সঙ্গে যাঁর নাম জড়িয়ে আছে, সেই কবি জীবনানন্দ দাশের জীবন অবলম্বনে রচিত হয়েছে এই উপন্যাস। সূর্যচেতনা আর যৌনচেতনার অপূর্ব সৃষ্টি এই উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে সময়ের ইতিহাস, কবির ইতিহাস-চেতনা, তাঁর রাজনৈতিক চেতনা ও আকাঙ্ক্ষা। একই সঙ্গে আবিষ্কৃত হয়েছে নর-নারীর আবহমান সম্পর্কের এক নতুন পরিসর। এর ভাষা মানবতান্ত্রিক পৃথিবীর ভাষা হয়ে উঠেছে। পরতে পরতে উঠে এসেছে ভারতবর্ষের রাজনীতি, দাঙ্গা ও বাংলার প্রকৃতি।

উপন্যাসটি লেখা নিয়ে লেখকের বক্তব্যঃ

সমাজ থেকে তাে মানুষ, মানে ব্যক্তি এমনি-এমনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না, একটা প্রক্রিয়া থাকে, সমাজের দিক থেকে, মানে যাদের সঙ্গে ব্যক্তির মেলামেশা, আর একটা দিক হল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব— একপক্ষ ব্যক্তিকে ‘সংঘচ্যুত করার প্রক্রিয়া চালায়, মূলত তার উপকরণ উপেক্ষা, তুমি আমাদের কেউ না বানিয়ে তােলা— ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব এক্ষেত্রে ব্যক্তিকে ‘সংঘ’ থেকে সরিয়ে নেয়— এটা ঘটেছিল আমার ক্ষেত্রে; তখন নিজেকে অসফল মনে হত, আত্মবিশ্বাস বলতে যা বােঝায় তা যেন একেবারেই তলানিতে, তখন, আমার প্রতিটি মনােভাবের প্রকাশ জীবনানন্দের কবিতায় আবিষ্কার করতাম— আর একটু একটু করে অসফলতার অন্য মানে আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে— যে মানুষ প্রকৃতির অংশ হিসাবে নিজেকে দেখতে শিখেছে তার প্রেমিক না-হয়ে উপায় নেই, তাকে বিপ্লবী হতেই হবে—আর এ-দুটি ক্ষেত্রে সফলতা সে ‘সুচেতনা'র মতাে সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ’– প্রেম মানে আরাে আলাে— মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়– জীবনানন্দীয় এই সব অনুভব আমার মাথায় হাত রাখে— এই সময়ে কফিহাউসে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা ভাঙাচোরা এক মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল, ব্যর্থ মানুষ।

তখন আমার মনে হয়েছিল এই দুজন আপাত অসফল মানুষের যে কোনও একজনের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলে আমি পরিত্রাণ পাব। কিন্তু কার মধ্যে একজন প্রায় আমার জন্মকালে প্রয়াত হয়েছেন আর একজন জীবিত, মুখােমুখি কথা বলার সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য, তখন বছর খানেক আলাপ হয়েছে, আলাপ করিয়েছেন আমার কবিবন্ধু সহকর্মী অরিজিৎ সিংহ— তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্রী, অরিজিতের সহকর্মী, জোনাকি ঘােষ রায়-এর সঙ্গে আমি তাকে ব্যাপারটি বলি। আমি আজও স্পষ্ট মনে করতে পারছি, কয়েক মুহূর্ত তার চেয়ে থাকা... তিনি বললেন, জীবনানন্দ। জানালেন তার কাছে জীবনানন্দ সমগ্র আছে, জীবনানদের জীবনে ঢুকে পড়াটা খুব সহজ-সাবলীল করে দিলেন তিনি— রিপুদাসত্বের বিরুদ্ধে মানবিকতার যে লড়াইয়ের কথা বলেছি, জীবনানন্দের সাহিত্যকৃতি এক অনন্য অভিজ্ঞতা দিয়েছে আমাকে, আমি আমার বিশ্বাসে স্থিত হয়েছি পুনরায় ।

এই উপন্যাস লেখার এটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। সামাজিক প্রেক্ষাপটে, জীবনানন্দকে আমার মনে হয়েছে এই বণিকসভ্যতাভিত্তিক আধুনিক সময়ের বিরুদ্ধে তিনি এক 'শান্ত বিপ্লবী'— আধুনিক সভ্যতা তীব্র আলাের আয়ােজনে যে অন্ধকার সৃষ্টি করেছে, জীবনানন্দের বয়ানে যা ‘অদ্ভুত আঁধার'— তার স্বরূপ উন্মােচনে জীবনানন্দ পথিকৃৎ, যারা অন্ধকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা। করেছেন, যুদ্ধ জারি রেখেছেন, আগামী দিনে যারা সৈনিক হবে- মানবিক সেনা, তাদের সামনে জীবনানন্দের ব্যক্তিগত লড়াই যেমন প্রেরণার বিষয়, তেমনই তার সংঘবাসনার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি তার জীবন আলেখ্য আমাদের অপ্রেমের থেকে প্রেমে গ্লানি থেকে আলােকের মহাজিজ্ঞাসায় নিয়ে যেতে পারে- এরকম সব সম্ভাবনার কথা মনে রেখে জীবনানন্দের ব্যক্তিত্বকে তার সময়কাল সমেত উপন্যস্ত করতে চেয়েছি।