Ticker

6/recent/ticker-posts

এক কাশ্মীরি পণ্ডিতকে আরেক কাশ্মীরি পণ্ডিতের খোলা চিঠি - সাদাত হাসান মান্টো

amarboi
প্রসঙ্গ কাশ্মীর :

এক কাশ্মীরি পণ্ডিতকে আরেক কাশ্মীরি পণ্ডিতের খোলা চিঠি —সাদাত হাসান মান্টো

ভাষান্তর : জয়ন্ত ঘোষাল

পণ্ডিতজি, আস্‌সালামােআলাইকুম !

এটা আমার আপনাকে লেখা প্রথম চিঠি। ঈশ্বরের করুণায়, আমেরিকানরা আপনাকে খুব সুদর্শন বলেন। আমিও এদিক থেকে খুব খারাপ নই। যদি আমেরিকায় যাই, হয়তাে আমাকেও একইরকম বলবে। কিন্তু আপনি ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী আর আমি পাকিস্তানের প্রখ্যাত গল্পকার। কী গভীর খাঁড়ি আমাদের বিচ্ছিন্ন করেছে। যদিও আমাদের মধ্যে যেটা মিল, তা হল আমরা দুজনেই কাশ্মীরি। আপনি একজন নেহরু, আর আমি একজন মান্টো। কাশ্মীরি হতে গেলে সুদর্শন হতে হয়, আর সুদর্শন হলে......আমি জানি না।

আমার দীর্ঘদিনের সাধ, আপনার সঙ্গে দেখা করার (হয়তাে এই জীবদ্দশায় আমাদের দেখা হবে)। আমাদের এদিককার বয়স্করা আপনাদের ওদিককার বয়স্কদের সঙ্গে দেখা করে। যদিও এখনও পর্যন্ত আমার আপনার সঙ্গে দেখা করার সৌভাগ্য হয়নি। ঈশ্বরের কী অপার করুণা যে, আমি আপনাকে চাক্ষুষ দেখিনি আজও। যদিও আপনার গলা শুনেছি রেডিওতে।

যা বলছিলাম, আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছে আপনার সঙ্গে দেখা করি। একজন কাশ্মীরি হয়ে আমরা একে অপরের কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু আজকাল আমি অবাক হয়ে যাই যে, কোথায় এই চাহিদাটা! একজন কাশ্মীরিকে অপর এক কাশ্মীরি মাড়িয়ে চলে যায়, গলিঘুঁজিদিয়ে কি, চৌরাস্তার মােড়ে।

আপনি একটা 'নেহর’-এর পাড়ে বেড়ে উঠেছেন, আর তাই সবাই আপনাকে 'নেহরু' বলে। আমি অবাক হয়ে ভাবি আমি, মান্টো হলাম কী করে। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ-কোটি বার কাশ্মীরে গিয়েছেন, আমি স্রেফ একবার বানিহাল পর্যন্ত যেতে পেরেছিলাম। আমার যে-সব কাশ্মীরি বন্ধুরা কাশ্মীরি ভাষা জানেন, তাঁরা বলেছেন, মান্টো মানে ‘মান্ট’, কাশ্মীরি ভাষায় যার মানে দেড় সেরের পাথরের বাটখারা। আমি নিশ্চিত, আপনি কাশ্মীরি ভাষা জানেন। যদি আপনি এই চিঠির উত্তর দেওয়ার ক্লেশ নেন, তবে দয়া করে ‘মান্টো’ শব্দের উৎসটা জানাবেন।

আমি একজন সামান্য দেড় সের, আর তাই আমাদের মধ্যে কোনও তুলনাই হতে পারে না। আপনি একটা সম্পূর্ণ স্রোত, যেখানে আমি স্রেফ একটা দেড় সের। আমি কী করে আপনার সঙ্গে যুঝব? যদিও আমরা দুজনেই একধরনের বন্দুক। কাশ্মীরিদের নিয়ে সবার জানা মুখ-ফিরতি কথাটা আছে না, ‘অন্ধকারে তাক কর'। দয়া করে, কথাটা খারাপভাবে নেবেন না। যখন আমি মুখ-ফিরতি কথাটা শুনেছিলাম, আমার ভয়ংকর লেগেছিল। যদিও এখানে এটা মজা করে বললাম, যাতে কথাটা শুনতে ভালাে লাগে। উল্টোদিকে, আমরা কাশ্মীরিরা কোনও যুদ্ধক্ষেত্রেই তাে পরাজয়কে মেনে নিই না।

রাজনীতিক হিসাবে, আপনার নাম আমি গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করি, কারণ, আপনি স্ববিরােধিতার শিল্পকে বিশেষভাবে আত্মস্থ করেছেন। আজকের দিনে আমাদের কাশ্মীরিদের সঙ্গে কুস্তিতে কে পারবে? কে পারবে আমাদের কাব্যময়তাকে খাটো করতে? কিন্তু আমি শুনে অবাক হয়ে গেছি যে, আপনি আমাদের দেশের নদীকে বাঁধতে চাইছেন।

পণ্ডিতজি, আপনি শুধুই একজন নেহরু। আমার আফশােস যে, আমি শুধুই ‘দেড় সের’-এর পাথুরে বাটখারা। যদি তিরিশ-চল্লিশ হাজার দেড় সের ওজনের পাথরের পাহাড় হতাম, তবে নিজেকে ওই নদীতে ছুঁড়ে দিতাম, যাতে আপনি আপনার ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে ভাবতে বসতেন, কীভাবে আমাকে হটানাে যায়।

পণ্ডিতজি, কোনও সন্দেহ নেই যে, আপনি বিরাট ব্যক্তিত্ব। আপনি ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী। আপনি একটি দেশের চালক, যা একদিন আমারও দেশ ছিল। আপনি সর্বৈব, কিন্তু ক্ষমা করবেন, যদি বলি আপনি এই নম্র মানুষটির কখনও কোনও খেয়াল রাখেননি।

আমি আপনাকে আমার বাবার একটা গল্প বলি। আমার বাবা, যিনি অবশ্যই একজন কাশ্মীরি ছিলেন, যখনই কোনও কসাই-এর খামারে যেতেন, তিনি লােকটিকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন, চামড়ার আসনে বসতে দিতেন, তারপর কাশ্মীরি চা আর কুলচা খেতে দিতেন। এরপর তিনি সেই পশুপালককে বলতেন, ‘আমিও একটা কসাই’। পণ্ডিতজি, আপনিও একজন কসাই। আল্লার কসম, যদি আমার জান নিতে চান, তবে আপনারটাও আমি ছাড়ব না। আমি জানি ও বিশ্বাস করি, আপনি কাশ্মীরকে আটকে রাখতে চান, কারণ, একজন কাশ্মীরি হয়ে আপনি সেই দেশের প্রতি চুম্বকীয় ভালােবাসা অনুভব করেন। সমস্ত কাশ্মীরি, এমনকি যে কখনও কাশ্মীরকে চাক্ষুষ করেনি, তারও এমনটা ভাবা উচিত।

যা বলেছি আগে, আমি শুধু একবার বানিহাল গেছিলাম। আমি কুদ, বাতাউত, খাস্তরের মতাে জায়গাগুলাে দেখেছি। অপার সৌন্দর্যের পাশাপাশি দেখেছি, তাদের চরম দারিদ্র। যদি আপনি সেই দারিদ্র মােচন করতে পারেন, তবে রাখুন কাশ্মীর আপনার কাছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আপনি তা পারবেন না, কারণ, আপনার কোনও সময় নেই।

আমাদের দুই পণ্ডিত ভাইয়ের মধ্যে এটা হােক, আমাকে ইন্ডিয়াতে ডেকে নিন। প্রথমে, আমি আপনার বাড়িতে গিয়ে শালিগম সাবদেগ’ বানাব, নিজের হাতে। তারপর কাশ্মীরের ব্যাপারে সব দায়িত্ব নেব। বক্সি আর বাদবাকি সবাইকে এখনই খারিজ করা দরকার। এরা এক নম্বরের প্রতারক। এদের এত উচুতে বসানাের আপনার কোনও কারণই ছিল না। এটাই কি তবে আপনাকে মানায়? কিন্তু কেন এত সব...? আমি জানি, আপনি একজন রাজনীতিক, যা আমি নই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমি কিছুই বুঝি না।

দেশটাকে ভাগ করা হল। র‍্যাডক্লিফ্‌প্যাটেলকে নিয়ােগ করল, এই নােংরা কাজটা করতে। আপনি বেআইনিভাবে জুনাগড়কে অধিকার করে রেখেছেন, যা একজন কাশ্মীরি শুধু একজন মারাঠার (আমি বলতে চাইছি প্যাটেল, ঈশ্বর তাঁর মঙ্গল করুক), প্রভাবে করতে পারে।

আপনি ইংরাজি ভাষার একজন দক্ষ লেখক, অপরপক্ষে আমি উর্দুতে ছােটোগল্প লিখি, যে ভাষাটিকে আপনার দেশ থেকে মুছে দেওয়া হচ্ছে। পণ্ডিতজি, আমি প্রায়ই আপনার মন্তব্য পড়ি এবং বুঝেছি, আপনি উর্দুকে আপনই ভাবেন। দেশ-বিভাজনের মুহূর্তে আপনার বক্তৃতা শুনেছি রেডিওতে। সবাই আপনার ইংরাজির প্রশংসা করেছিল। কিন্তু আপনি যখন তথাকথিত উর্দুতে বললেন, মনে হল, যেন হিন্দু মহাসভার ক্ষিপ্ত কেউ আপনার ইংরাজিটির তর্জমা করে দিয়েছেন, যা কোনওভাবেই আপনাকে মানায় না। আপনি প্রতিটা লাইনে হোঁচট খাচ্ছিলেন। আমি কল্পনাও করতে পারি না যে, আপনি এভাবে উচ্চৈঃস্বরে পড়তে রাজি হলেন কী করে!

এটা সেই সময়, যখন র‍্যাডক্লিফ্‌ইন্ডিয়াকে একটা রুটিকে দু'ভাগে ভাগ করার মতাে ভাগ করে দিল। আর এটা সবচেয়ে আপত্তিকর যে, ওরা সেটাকে সেকেও দেখেনি। আমরা রুটিটার এদিকটা সেঁকছি, আর আপনারা ওদিকটা। কিন্তু আমাদের চুলায় বাইরে থেকে কেউ আগুন লাগাচ্ছে।

পণ্ডিতজি, এটা বাবুগােসারমরশুম। আমি প্রচুর গােসা খেয়েছিলাম, যদিও এখনও বাবুগােসা খাওয়ার জন্য উচাটন হই। দেখুন, কী অনৈতিক ব্যাপার, বক্সিকে আপনি সব বাবুগােসার অধিকার দিয়ে দিলেন, আর সে আমাকে কয়েকটা অন্তত উপহার হিসেবেও পাঠাল না। ঠিক আছে বাবুগােসা সুদ্ধ সব উপহারগুলাে নরকে যাক... না, আর কোনও দ্বিতীয় ভাবনা নয়।

আসলে আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই, আপনি কি আমার কোনও বই পড়েছেন? যদি পড়ে থাকেন, আমি দুঃখের সঙ্গে বলতে চাই যে, আপনি আমার লেখার কোনওরকম সুখ্যাতি করেননি।

আপনি নিজে একজন লেখক, যদি আদৌ আপনি আমার কোনও লেখা না পড়ে থাকেন, সেটাই সবচেয়ে দুঃখের। আমার আপনার বিরুদ্ধে আরও একটা ব্যাপারে অসন্তোষ আছে। আপনার থেকে সমর্থন পেয়েই, আমাদের নদীর জল আটকে দেওয়া হচ্ছে, আর আপনার রাজধানীতে আমার অনুমতি ছাড়াই প্রকাশকরা হড়বড় করে আমার বই ছাপাচ্ছে। এটা কি সঠিক? আমি মনে করি না, আপনার জমানায় এই ধরনের অনৈতিক কাজ প্রশ্রয় পেতে পারে। খোঁজ করলেই জানতে পারেন, কতজন প্রকাশক দিল্লি, লখনৌ, আর জলন্ধরে আমার বই-এর পাইরেসি করেছে।

অশ্লীলতার দায়ে আমার বিরুদ্ধে অনেক আইনি ফরমান জারি হয়েছে। কিন্তু দেখুন, আপনার নাকের ডগায়, দিল্লিতে কী অবিচার হচ্ছে। একজন প্রকাশক “মান্টো'র অশ্লীল কাহিনি” নাম দিয়ে আমার একটি গল্পের বই ছেপেছে। আমি একটি বইয়ের নাম দিয়েছিলাম ‘গঞ্জে ফরিস্তে। একটি ইন্ডিয়ান প্রকাশক এটা ছেপেছে ‘পর্দার আড়ালে’ নাম দিয়ে। ...এখন বলুন আমার কী করা উচিত?

আমি একটি নতুন বই লিখেছি। আপনার উদ্দেশে লেখা এই চিঠিটা সেই বইয়ের প্রস্তাবনা। যদি এই বইটাও পাইরেট করা হয়, তবে আল্লার কসম, আমি যেকোনও দিন দিল্লি চলে আসব, আপনার গলা এমন চেপে ধরব, যে ছাড়াতে পারবেন না ...আমি এমন আঁকড়ে ধরব যে, আপনি সারা জীবন মনে রাখবেন।

প্রতিদিন সকালে আমাকে নােনতা চা, কুলচা খাওয়াতে হবে, আর প্রতি হপ্তায় অন্তত একবার শালিগম সাবদেগের দাওয়াত।

বইটি বেরােনাে মাত্র আমি আপনাকে একটি কপি পাঠিয়ে দেব। আশা করি, আপনি প্রাপ্তিস্বীকার করবেন, আর আপনার মতামত জানাবেন।

আপনি তাে জানেন, আমাদের কাশ্মীরে ঘানি বলে এক কবি ছিলেন, যাঁকে সবাই ‘ঘানি কাশ্মীরি' বলে ডাকত। ইরান থেকে এক কবি এসেছিলেন দেখা করতে। ঘানির বাড়ির দরজা খােলা ছিল। ঘানি বলতেন, 'আমার বাড়িতে কী আছে যে, দরজায় তালা লাগিয়ে রাখব? ঠিক আছে, আমি যখন বাড়িতে থাকব, তখন দরজা দিয়ে রাখব। কারণ, এ বাড়িতে একটাই সম্পদ, সেটা হলাম আমি।'

তাে, ইরানি কবিটি ফাঁকা বাড়িতে তাঁর লেখার খাতাটি ফেলে চলে যান। সেই খাতায় একটি অসমাপ্ত চতুষ্পদী ছিল। ইরানি কবিটি সেই পদের দ্বিতীয় স্তবকটি লিখলেও, প্রথমটি লিখে উঠতে পারেননি। সেই দ্বিতীয় স্তবকটি ছিল এরকম ‘পােড়া মাংসের গন্ধ উড়ে আসছে তােমার পােশাক থেকে। ইরানি কবিটি ফিরে এসে দেখেন যে, প্রথম স্তবকটি লেখা হয়েছে এভাবে, ‘দগ্ধ হৃদয়ের কোনও হাত কি তােমার পােশাককে ছুঁয়েছিল?

পণ্ডিতজি, আমিও দগ্ধ হৃদয়।

আমি বিষয়টি উত্থাপন করলাম, কারণ আমার বইটি আপনাকে উৎসর্গ । করছি।

সাদাত মান্টো

২৭ অগাস্ট, ১৯৫৪

টীকা:

১. শালিগম সাবদো - ভেড়ার নরম দেহাংশ আর শালগম দিয়ে বানানাে মাংসের পদ।

২, এটি মধ্য এশিয়ায় বিশেষত ব্যবহৃত হয়, লােহার ঝাঁঝরির মতাে যাতে কাঠকয়লা থাকে, খাবার গরম রাখার জন্য। ভারতে কাশ্মীর ছাড়া এর বিশেষ ব্যবহার দেখা যায় না, “চুলা' লিখতে বাধ্য হলাম। কারণ, এর কোনও ভারতীয় প্রতিশব্দ খুঁজে পাইনি।

৩. নাসপাতির মতাে দেখতে একরকমের ফল।

৪, গুলাম মহম্মদ বক্সি কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন শেখ আবদুল্লাহর গ্রেফতারের পর।

৫. উর্দুতে লেখা চিঠিটির পাঁচ মাস পরে মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে মান্টো মারা যান।

এখানে যে বইটির কথা বলা হয়েছে, সেটি মান্টোর বই 'বায়ের উনওয়ান-কে, যা পণ্ডিত নেহরুকে উৎসর্গ করেছিলেন সাদাত হাসান মান্টো।

চিঠির প্রসঙ্গে কিছু কথা

২৭ অগাস্ট, ১৯৫৪-তে লেখা এই চিঠিটির পাঁচ মাস পরে ১৯৫৫-র ১৮ জানুয়ারি, মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে প্রখ্যাত উর্দু কথাসাহিত্যিক সাদাত হাসান মান্টোর জীবনাবসান হয়। চিঠিতে যে বইটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, মান্টোর লেখা সেই বইটির নাম ‘বগয়ের উনওয়ান-কে'। এই বইটি তিনি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে উৎসর্গ করেছিলেন। মান্টো চিঠিটি লিখেছিলেন উর্দুতে। পরে এটি হিন্দিতে অনূদিত হয়, সেখান থেকে হয় ইংরেজিতে। এক কাশ্মীরি পণ্ডিতের ক্ষোভ, বিক্ষোভ, দেশভাগের যন্ত্রণা, জাতিসত্তার প্রতি প্রেম, রাজনৈতিক দর্শন থেকে উর্দু ভাষার প্রতি আনুগত্যের এক তেজোদীপ্ত আলেখ্য মান্টোর এই চিঠিটি, যা তিনি লিখেছিলেন অপর এক বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিক, কিন্তু আদপে এক কাশ্মীরি পণ্ডিতকে।

চিঠিটি শুরু হয়েছিল নেহরুর রূপবত্তার জয়গান দিয়ে। ঈশ্বরের করুণায়, আমেরিকানরা আপনাকে খুব সুদর্শন বলেন। আমিও এদিক থেকে খুব খারাপ নই। যদি আমেরিকায় যাই, হয়তাে আমাকেও একইরকম বলবে। মান্টোর এই রসাত্মক উক্তিটির অতলে রয়েছে সত্যের রূপদর্শনের অবিচল প্রজ্ঞা। সেইসব দিনে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু যেন নানা রূপকথার নায়ক। সবকিছু তাে ইতিহাসের দলিলে ঢােকে না। আর অনেক 'মিথ’-ই লােকশ্রুতির মতাে একপ্রকার আরােপিত। বহু বিদেশি নারীর নেহরু-প্রীতি ছিল তেমন। কিন্তু মান্টো যেন বলতে চাইছেন, নেহরুর এই রূপের খ্যাতি আসলে আমেরিকানদের প্রচারের অঙ্গ। মান্টোর মতাে সাধারণ কেউ যদি আমেরিকায় যান, তাে তিনিও এমন খ্যাতি অর্জন করবেন। বড় নিষ্ঠুর এই রসিকতা। এই রূপের খ্যাতি, ‘ঈশ্বরের দয়া’ বা প্রকৃতির দান নয়, বরং পশ্চিমের চাটুকারিতার ফলাফল। 'সবক্‌-ই-হিন্দ্‌’বা ভারতীয় ধারার ফার্সি কবিতার সতেরাে শতকের বিশিষ্ট কবি ঘানি কাশ্মীরি’র উল্লেখও তাই নজর কাড়ে। দুই কাশ্মীরি পণ্ডিতের চিঠির মধ্যে এসে সমগ্র কাশ্মীরি সত্তার প্রকাশ হয়ে দাঁড়ান ঘানি কাশ্মীরি। নেহরুর পদবির সঙ্গে যেমন ‘নেহের' বা নদীর যােগ, তেমনই মান্টোর কথায় তাঁর পদবির মানে কাশ্মীরি ভাষায়, দেড় সের। অথচ স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বিয়াস নদীর জল আটকে দিতে চাইছেন। তৎকালীন পাকিস্তানের নাগরিক মান্টোর পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এক কাশ্মীরি পণ্ডিতের এ হেন আচরণের মধ্যে যেন আগ্রাসন দেখতে পাচ্ছেন অপর এক কাশ্মীরি পণ্ডিত, অথচ কয়েক বছর আগেই ইন্ডিয়া তাে তাঁরও দেশ ছিল।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মান্টো ১৯৫১ থেকে ১৯৫৪-তে নয়টি চিঠি লিখেছিলেন ‘UNCLE SAM'-কে। অনেকেই জানেন, এই UNCLE SAM আমেরিকার এক যুদ্ধবাজের নাম, যে বাস্তবের চরিত্র না হয়েও সেই দেশটির আগ্রাসনের কায়া। সেই Uncle-এর U আর Sam-এর S জুড়েই তাে প্রবল প্রতাপশালী US। সদ্য স্বাধীনতা-প্রাপ্ত পাকিস্তানের নাগরিক মান্টো ‘পয়সার অভাবে ডাকে না পাঠানাে ন’টি চিঠি লিখেছিলেন US বা আমেরিকাকে উদ্দেশ করে, যেখানে পরতে পরতে ছিল পাকিস্তানের রাজনীতিকদের আমেরিকার কাছে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের আর আমেরিকার চতুর কৌশলের প্রতি তীব্র শ্লেষ, ক্ষোভ, আর তার পাশাপাশি নিজের দেশের সরকারের ‘অশ্লীলতার দায়ে মান্টোকে জেল ও জরিমানার কারণে একজন শিল্পীর স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল। এখানে এটি উল্লেখ করলাম তার কারণ, সেই ন'টি চিঠির প্রথমটিতে মান্টো লিখছেন,

'চাচা, আপনার পাকিস্তানি ভাতিজা চিঠি লিখছে যাকে আপনি চেনেন না, আপনার সাত-স্বাধীনতার দেশের কেউই তাকে চেনে না। আপনার জানা উচিত, হিন্দুস্তান থেকে কেন আমার দেশটাকে কেটে নিয়ে দেশের পরিচয় আর স্বাধীনতা দেওয়া হল। আর সেই কারণেই আমি আপনাকে চিঠি লেখার এই দুঃসাহস দেখাতে পারছি। দেশের মতাে আমিও স্বাধীন হয়েছি। পর-কাটা পাখি কেমন করে স্বাধীনতা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভােগ করতে পারে, চাচা, আপনাকে এই সব জানা জিনিসগুলাে বলে সময় নষ্ট করব না। আমার নাম সাদাত হাসান মান্টো, যেখানে জন্মেছিলাম, সেটা এখন হিন্দুস্তানে পড়ে। আমার মা সেখানে কবরে শুয়ে। আমার বাবাকে সেখানে কবর দেওয়া হয়েছে। আমার প্রথম সন্তানটিও সেখানকার মাটির তলায় বিশ্রাম নিচ্ছে। যদিও সেটা আর আমার দেশ নয়। আমার দেশ এখন পাকিস্তান, যা আমি ব্রিটিশের প্রজা হিসেবে আগে পাঁচ-ছ'বার দেখেছি। ... চাচা, বিশ্বাস করুন সাত-স্বাধীনতার দেশে একটা নভেল অশ্লীলতার দায়ে বিচারে মুখে পড়ছে শুনে আমি বিস্মিত হয়ে গেছি। আর আপনার দেশে শেষমেশ সব কিছুর বাইরের চামড়া চুলে জানলায় সাজিয়ে বিক্রি করাটাই তাে রীতি, তা সে তাজা ফল কি কাঁচা মেয়েমানুষ, যন্ত্র কি জন্ত, বই কি ক্যালেন্ডার।

আসলে দেশভাগের যন্ত্রণা ক্ষোভ, মৃত্যু অবধি তাড়া করেছিল মান্টোকে। কারণ, দেশভাগ নিয়ে মান্টো বলেছিলেন, “হিন্দুস্তান মুক্ত হয়েছিল, পাকিস্তান জন্মলগ্নেই স্বাধীনতা পেয়েছিল, কিন্তু দু'দেশের মানুষ তখনও দাসত্বের মধ্যেই ছিল, কুসংস্কারের দাস, ধর্মীয় মৌলবাদের দাস, বর্বরতার ও মানবিকতাহীনতার দাস।' মান্টো বামপন্থী বা কমুনিস্ট ছিলেন না, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ উচ্চকণ্ঠে না বললেও যা বলেছিলেন, তার অন্তর্নিহিত মানে কি অভিন্ন নয়? একজন পাকিস্তানি নাগরিক এই চিঠিতে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে লিখছেন, ‘রাজনীতিক হিসাবে, আপনার নাম আমি গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করি, কারণ, আপনি স্ববিরােধিতার শিল্পকে বিশেষভাবে আত্মস্থ করেছেন। দেশভাগের যন্ত্রণায় দগ্ধ ‘তােবা টেক সিং’-এর লেখক ও কথাশিল্পী মান্টোর শিল্পীর স্ববিরােধিতার স্বাভাবিক প্রবণতাকে জানেন, তাই লেখক নেহরুর একে রাজনীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার প্রবণতাকেই আক্রমণ করেছেন তীব্র শ্লেষে। কী করে একজন নেহরু, যাঁর জন্ম নদীর পাশে, এমন করে নদীকে বেঁধে দিতে পারেন, এটা ‘দেড় সের’ মান্টো বুঝতে পারেন না। বুঝতে পারেন না, কারণ, মান্টো রাজনীতিক নন। তিনি অনুভব করেন, একজন শিল্পীর মনন নিয়ে ভাবেন, এই পৃথিবীর জল-হাওয়া-নদী, পাহাড় ভাগ হয় না। কিন্তু রাজনীতি একটা দেশের ভূখণ্ডকে টুকরাে করার সিলমােহর দিলে, নদীকে নয় কেন? এই অপার অবারিত সম্পদের এ হেন ভাগবাটোয়ারা না মানতে পারা মান্টো, রাষ্ট্রের খরবদারি না মানতে পারা মান্টো লিখেছিলেন ‘ইয়াজিদ' শীর্ষক একটি ছােটোগল্প, যা রাজনীতিক নেহরু হয়তাে পড়ে দেখার ফুরসত পাননি বা ইচ্ছাই করেননি।

মান্টো ততদিনে পাকিস্তানের নাগরিক, যদিও তিনি নেহরুকে বলেছেন, ‘আপনি একটি দেশের চালক, যা একদিন আমারও দেশ ছিল। বস্তুত নেহরু আর মান্টো, দু'জনেই কাশ্মীরের ভূমিপুত্র। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নেহরুর কাছে কাশ্মীর এক সমস্যার দ্যোতক, যা সেই স্বাধীনতার মুহুর্ত থেকে আজও এদেশের সব প্রধানমন্ত্রীর কাছেই একইরকম। আর এই রাজনৈতিক সমস্যাকে মােকাবিলা করার পদ্ধতিটারও কিছুমাত্র কি পরিবর্তন হয়েছে? সেদিন থেকে আজও সব দিল্লির সরকারই ভেবেছে তারা যা করছে, সেটাই একমাত্র ‘সঠিক’ ও ‘বিকল্পহীন’ ব্যবস্থা। কাশ্মীরকে নেহরুও ‘সমস্যা’-ই ভেবেছিলেন। সেদিন তাই রাজনৈতিকভাবেই তাকে মােকাবিলা করতে চেয়েছিলেন, অথচ সাধারণ নাগরিক সমাজের জন্য কোনও আলােচনার পরিসর রাখা হল না। গঠনমূলক আলােচনা করার জন্য কোনও ক্ষেত্র, কোনও সুযােগ কি আজও আছে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষদের কাছে? রাজনৈতিকভাবে একটা তৈরি করা সমস্যাকে মােকাবিলা করতে গিয়ে দুটি দেশ অস্ত্রকেই বেছে নিয়েছে বারবার। মান্টো কিন্তু সেই ১৯৫৪-তেই বলেছিলেন, ‘আমাদের দুই পণ্ডিত ভাইয়ের মধ্যে এটা হােক, আমাকে ইন্ডিয়াতে ডেকে নিন। প্রথমে, আমি আপনার বাড়িতে গিয়ে শালিগম সাবদেশ বানাব, নিজের হাতে। তারপর কাশ্মীরের ব্যাপারে সব দায়িত্ব নেব। বক্সি আর বাদবাকি সবাইকে এখনই খারিজ করা দরকার। এরা এক নম্বরের প্রতারক। এদের এত উঁচুতে বসানাের আপনার কোনও কারণই ছিল না। এটাই কি তবে আপনাকে মানায়? কিন্তু কেন এত সব...? আমি জানি, আপনি একজন রাজনীতিক, যা আমি নই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমি কিছুই বুঝি না।

মান্টো জানতেন, সব দায়িত্ব পেলে তিনিও হয়তাে ব্যর্থ হতেন, কিন্তু তাতে কী? অন্তত আলােচনার সুযােগটা তাে পাওয়া যেত। একজন সাধারণ কাশ্মীরি নাগরিক হিসেবে মান্টো নেহরুর কাশ্মীরের প্রতি ‘চুম্বকীয় ভালােবাসা'-কে তাই বিদ্রুপ করছেন। কারণ, যাঁরা কেবলমাত্র রাজনৈতিকভাবে সমস্যা নিরসন করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন, সেই গুলাম মহম্মদ বক্সি বা নেহরুর থেকে কাশ্মীরের মূল দাবি দারিদ্র মােচনের কাজটা কথাসাহিত্যিক মান্টো ভেবেছেন, তিনি হয়তাে অনেক ভালােভাবে, অনেক সমানুভূতির সাথে সমাধান করতে পারতেন। যদিও এটাও সত্যি যে, একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে মান্টো হয়তাে কিছুই পারতেন না। কিন্তু সামান্য সুযােগও যদি দেওয়া হত, তবে মনে হয়, কাশ্মীরের দুঃখ-দুর্দশা মােচন সেখানকার সাধারণ নাগরিকেরাই অনেকটা বেশি করতে পারত। অহােরাত্র সেনার রুটমার্চ-এর মচমচ্ আওয়াজ তাদের সেই যে শীত-কুঠুরিতে ঢুকিয়ে দিল, আর বেরিয়ে এল না। সাধারণের ও নাগরিক সমাজের কণ্ঠস্বর– যারা বলতে পারত, আমাদের দুঃখ-কষ্ট আমরাই সব থেকে বেশি চিনি ও জানি এবং এর সমাধান নানা ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও আমরা নিজেরাই সবচেয়ে ভালাে করে করতে পারব।

কিন্তু এ চিঠি তাে একজন কাশ্মীরি পণ্ডিতের অপর এক কাশ্মীরি পণ্ডিতকে লেখা। নেহরু যেমন কাশ্মীরি, তেমনই ইংরেজি ভাষার তুখােড় সাহিত্যিকও বটে। কিন্তু যে নেহরুকে মান্টো এই চিঠি লিখছেন, তিনি আসলে ততদিনে একটা প্রতিষ্ঠান এবং একটা দেশের নামান্তর। যেন নেহরু মানেই ইন্ডিয়া, যা পরে ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ' হয়েছিল নেহরু-নন্দিনী 'ইন্দিরা’ আর ‘ইন্ডিয়া’ মিলেমিশে গিয়ে। সেই সলতে পাকানাের সময়টাকেই যেন মান্টো দেখতে পেয়ে গেছিলেন। মান্টো যদিও কাশ্মীরের ভারতভূক্তি মানতে পারেননি। এ নিয়ে আমাদের ক্ষোভ করার কিছু নেই। লেখক হলেও একজন স্বাভাবিক পাকিস্তান নাগরিকের চাহিদাকে আমাদের নিজেদের অবস্থান থেকে দেখলে চলবে না। এখানে মান্টোর কিছু ভুলও হয়েছিল, কেননা জুনাগড়ের নবাব পাকিস্তানভুক্তি চাইলেও, সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু নাগরিক আবার ভারতভুক্তি চেয়েছিলেন এবং সেই দাবি মতাে ১৯৪৮-এ জুনাগড়ের ভারতভুক্তি হয়। যদিও মান্টোর চাহিদার মধ্যে কিন্তু অন্য মােচড়ও ছিল। নেহরুর কাশ্মীরকে ভারতে যুক্ত করাকে তাঁর মনে হয়েছিল, অনেক বেশি রাজনৈতিক কৌশল। একজন কাশ্মীরির কাশ্মীরের প্রতি আবেগের প্রকাশের থেকে নেহরু-নিযুক্ত বল্লভভাই প্যাটেলের দৌত্যকে মান্টোর মনে হয়েছিল একধরনের দ্বিচারিতা। তাই তিনি লেখেন, 'আমি জানি ও বিশ্বাস করি, আপনি কাশ্মীরকে আটকে রাখতে চান, কারণ, একজন কাশ্মীরি হয়ে আপনি সেই দেশের প্রতি চুম্বকীয় ভালােবাসা অনুভব করেন। মান্টো নেহরুর কাশ্মীরের প্রতি ‘চুম্বকীয় ভালােবাসা'-কে রাজনৈতিক দৃষ্টিতেই দেখেছেন।

তাঁর হয়তাে মনে হয়েছে, নেহরু সেখানকার জনজাতিদের দুঃখ-দারিদ্র মােচনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার চেয়েও, তাদের আটকে রাখতে বেশি আগ্রহী। তাই অক্লেশে বলেন, 'যদি আপনি (কাশ্মীরের) সেই দারিদ্র মােচন করতে পারেন, তবে রাখুন কাশ্মীর আপনার কাছে।অর্থাৎ কাশ্মীর কার কাছে থাকল, সেটা মান্টোর কাছে বড়াে নয়। শেষমেশ যা বড়াে তা হল, একজন ভূমিপুত্রের অপর ভূমিপুত্রের কাছে তাঁদের প্রিয় ভূখণ্ডকে ভালাে রাখার দাবি। শুধু এইটুকুই নয়, মান্টো আরও বলেছেন, দেশ-বিভাজনের মুহূর্তে আপনার বক্তৃতা শুনেছি রেডিওতে। সবাই আপনার ইংরাজির প্রশংসা করেছিল। কিন্তু আপনি যখন তথাকথিত উর্দুতে বললেন, মনে হল, যেন হিন্দু মহাসভার ক্ষিপ্ত কেউ আপনার ইংরাজিটির তর্জমা করে দিয়েছেন, যা কোনওভাবেই আপনাকে মানায় না।বাস্তবিকই বল্লভভাই প্যাটেল ও হিন্দু মহাসভার ছায়া যে কংগ্রেসের রাজনীতিতে ছায়া ফেলছিল, সেটা কে অস্বীকার করবে? ‘The communalism of a majority is apt to be taken for nationalism.'— Jawaharlal Nehru on January5, 1961. এই কথাটা তাে ‘সংবেদনশীল সাহিত্যিক নেহরু বুঝেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নেহরুর জমানায় কাশ্মীর সমস্যার একমাত্র নিরসন ছিল যে যুদ্ধ, তা তাে এই উক্তির এক বছরের মধ্যে দু'টি দেশই প্রমাণ করে ছেড়েছিল। তেমনই হিন্দু লবির শুধু যে কাশ্মীর নয়, সমগ্র দেশ জুড়েই একটা প্রচ্ছন্ন ছায়া তৈরি হচ্ছিল দেশভাগের আগে থেকেই। সে ব্যাপারে প্যাটেলপন্থীদের যে সমর্থন ছিল, তার জন্যে একটা ছােটো ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে, যা শুনতে তেমন প্রখর না হলেও প্যাটেলের মননকে বুঝতে পারা যায়, তা হল ১৯৪৫-এ বম্বে শহরে মেরিন ড্রাইভের কাছে চৈপট্টিতে ‘প্রাণসুখলাল মফতলালহিন্দু সুইমিং ক্লাব’-এর উদ্বোধনে একমাত্র যে মান্যগণ্য কংগ্রেস নেতা উপস্থিত ছিলেন, তিনি সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। এখানে উল্লেখ্য, সেই সুইমিং ক্লাবটিতে ২০১১ সাল অবধি কোনও অ-হিন্দুর প্রবেশাধিকার ছিল না। এই চিঠির পরের অংশে মান্টোর উদ্বিগ্নতা ছিল উর্দূ নিয়ে ও তার বইয়ের ইন্ডিয়াতে হওয়া পাইরেসি নিয়ে। কাকতালীয়ভাবে সতেরাে শতকের ‘সবক্-ই হিন্দ্‌’-এর কবি ঘানি কাশ্মীরি’রও এই আক্ষেপ ছিল! ঘানিও লিখেছেন, '...আমার চ্যালারা আমার লেখা পঙক্তি, আমার নাম না করেই (চুরি করে) লিখে দিচ্ছে।' একজন উর্দু কথাসাহিত্যিকের তাঁর নিজের ভাষা ও স্বরচিত গ্রন্থের আত্মপরিচয় নিয়ে তাগিদ থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে মান্টো একজন কাশ্মীরির থেকে, এক্ষেত্রে নেহরুর কাছ থেকে, দাবি করছেন উর্দুর কৌলীন্য রক্ষার।

ভাষার রাজনীতি যেমন আছে, তেমনই রাজনীতির বর্শার ফলার মুখেও ভাষাকে বসানাে হয়। মান্টো বলেছেন, 'আপনি ইংরাজি ভাষার একজন দক্ষ লেখক, অপরপক্ষে আমি উর্দুতে ছােটোগল্প লিখি, যে ভাষাটিকে আপনার দেশ থেকে মুছে দেওয়া হচ্ছে।' এখানে মান্টো ইন্ডিয়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছেন 'আপনার দেশ’ বলে। মান্টো এতদূরও বলে ফেলেন — 'পণ্ডিতজি, আমি প্রায়ই আপনার মন্তব্য পড়ি এবং বুঝেছি, আপনি উর্দুকে আপনই ভাবেন।' যদিও মান্টোর ১৯৫৪-তে লেখা চিঠিটির এই উর্দুর অংশটুকুকে নিয়ে বলার অবকাশ আছে। কারণ, কাশ্মীরের বিভিন্ন অংশের কথ্য লৌকিক ভাষাগুলােকে ধ্বংস করে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়া চলছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই। কাশ্মীরি ভাষাকে কোণঠাসা করে, উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার ভেতর চতুর সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক খেলা আর ভাষাকে ব্যবহার, এভাবে এক শ্রেণীর চেতনাকে ইসলামিকরণের দিল্লির রাজনীতি আজ বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। ঠিক যেভাবে, সংস্কৃতকে বছর দুয়েক আগে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দেওয়ার মতাে করে কেন্দ্রীয় সরকারি স্কুলগুলােতে তৎকালীন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি তাঁর দলের ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের গৈরিকীকরণের লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যবহার করার ফতােয়া দিয়েছিলেন। গােলাম বক্সিরাকী এভাবেই নেহরু ও কংগ্রেসের সাহচর্যে দু-নৌকোয় পা রেখে নিজেদের আখের গােছাতে গেছিলেন? কৌম রাজনীতিকে ভাষার সাহায্যে বিভাজনের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলাফল দেখা যাচ্ছে। কারণ, যা ছিল দুই দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা আর মিলিটারি শক্তি দেখানাের পাদানি, সেখানে সুযােগ বুঝে আজ ইসলামি মৌলবাদের বর্বর সংগঠনগুলােও পা রাখছে, যা আরও রক্ত, আরও হিংসা, আরও মৃত্যুকেই ডেকে আনবে। আর এই পরিস্থিতি কিন্তু এদেশের শাসকদের তৈরি করা হঠকারিতার কারণেই ধীরে ধীরে ঘটেছে।

ইতিহাসের চাকা ঘােরে। 'সবক্‌-ই-হিন্দ্‌’-এর ফার্সি কবিরা একদিন পারস্য ও বর্ধিত পারস্যের ধ্রুপদী ফার্সি কবি ও লেখকদের নাকউঁচু সমালােচনার কারণেই ধীরে ধীরে নিম্নবর্গের ভাষা রেখতা বা উর্দুকে আপন করে নিয়েছিলেন। আবার সেই উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানে যে জাতিসত্তার ঝড় উঠেছিল ১৯৫২-তে, বাংলা ভাষাকে আশ্রয় করে তা বাঙালির জাতিসত্তার উন্মেষের কারণ হয়ে দাঁড়াল। শুধু এদেশেই নয়, পাকিস্তান গঠনের পর পূর্ব ও পশ্চিম দু-তরফেই পাকিস্তানের বেশিরভাগ প্রদেশের আঞ্চলিক ভাষাগুলােকে নস্যাৎ করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া চলছিল, আর ভাষাকে ব্যবহার করে ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ ধর্মীয় ভাবাবেগকে খুঁচিয়ে তুলতে উর্দুর মতাে মায়াবী ভাষাকে ক্ষমতার রাজনীতির নােংরা খেলায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেটা মান্টোর মতাে মানবদরদি লেখকের কেন চোখ এড়িয়ে গেল, সেটাও অবাক করে।

অপরদিকে, এভাবেই একদলীয় শাসকের ইচ্ছেয় হিন্দিকেও আপামর ভারতীয় জনগণের ভাষা বলে যে প্রচার শুরু হল নেহরুর জীবদ্দশাতেই, তা থেকেই হিন্দি বলয়ের রাজনীতির মেরুকরণের সূত্রপাত হয়েছিল। অর্থাৎ হিন্দি আর উর্দুকে কৌম রাজনীতিতে জড়িয়ে নেওয়া হল। ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের সব সরকারই আজও এটাকে বহাল রেখেছে নিজের নিজের কায়দায়। যদিও এখানে মান্টোর কিছু ভুল হয়েছিল শিল্পীর স্ববিরােধিতার অভ্যাসে, তবু মান্টো এ বিষয়েও অন্য এক জায়গায় লিখেছিলেন— ‘হিন্দি আর উর্দু নিয়ে অনেকদিন ধরে বিবাদ চলছে। মৌলভি আবদ্‌-উল-হক, ডা: তারা সিং, মহাত্মা গান্ধি— বিবাদের কারণগুলাে সবটাই জানেন। আমার কাছে এ দুটো ভাষা অচ্ছেদ্য। অনেক চেষ্টা করেও এই বিবাদের কারণ কী, বুঝিনি। কেন যে হিন্দুরা হিন্দি সমর্থন করে, আর মুসলিমরা উর্দুকে হাতিয়ার করে অনর্থক সময় নষ্ট করছে। একটা ভাষা তৈরি করা যায় না, এ নিজেই নিজেকে গড়ে। আর মানুষের কোনও শক্তি নেই যে কোনও একটা ভাষাকে ধ্বংস করে দেবে।'

আর এখানেই তিনি সাদাত হাসান মান্টো, এক নয়, দুই নয়, দেড় সেরের পাথুরে বাটখারা! কে জানে, ক্ষোভে-বিক্ষোভে সেই পাথরের টুকরােগুলােই আজ কাশ্মীরের ‘বেপথু (?) যুবকদের হাতে উঠে আসছে কিনা।

আবার ফিরে যাই একবার মান্টোর ‘UNCLE SAM'-কে লেখা প্রথম চিঠিটার প্রসঙ্গে, যেখানে মান্টো বলছেন— “...একশো বছর আগে আমাদের দেশের কবি মির্জা গালিব লিখেছিলেন:

‘যদি আমার মৃত্যুর পর অপমানিত হওয়াটাই আমার লিখন হয়,

তবে আমি ডুবে মরতে চাই।

যেন আমার কবরের ওপর

শান্তিতে থাকার ফলক লাগানাের থেকে নিষ্কৃতি পাই।'

গালিব বেঁচে থাকতে অপমানিত হতে ভীত ছিলেন না, কারণ সারা জীবন তার সঙ্গেই সহবাস ছিল। যেটা গালিব ভয় পেয়েছিলেন, সেটা মৃত্যুর পরের অপমান…

আজকে প্রতিদিন মরে যাওয়া কাশ্মীরি আত্মাকে, ছররা গুলিতে অন্ধ চোখের শিশু-কিশােরদের প্রাপ্য বেঁচে থাকাকে, যেন একটা প্রবল আধিপত্যকামী রাষ্ট্রের নিষ্ঠুর দম্ভ মরার পরেও নিরন্তর অপমান করে চলেছে। কাশ্মীরি নেহরু যদি কাশ্মীরের প্রকৃত আজাদির আকাঙ্ক্ষাকেপ্রধানমন্ত্রী না হয়ে, একজন ‘কাশ্মীরি' হিসেবে বুঝতেন, তবে হয়তাে এই চলমান মৃত্যুর মিছিলকে থামিয়ে দেওয়া যেত।
বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!