Ticker

6/recent/ticker-posts

দীর্ঘদিনের মুসলিম বিদ্বেষ কী ভারতের ভবিষ্যত প্রজন্ম ক্ষমা করবে?

দীর্ঘদিনের মুসলিম বিদ্বেষ কী ভারতের ভবিষ্যত প্রজন্ম ক্ষমা করবে?

লেখাটি Sameena Dalwai এর লেখার সংক্ষিপ্ত রূপ


যখন দেশকে ভাঙা হচ্ছে তখন ভারতীয়রা কী করেছে না করেনি সেই গ্লানি আসন্ন প্রজন্মকে বহন করতে হবে।

ভারত রাজ্যের একটি অংশ যেখানে আমি বাস করি সেখানে আগুন লেগেছে। আমি হরিয়ানা রাজ্যের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই সেখান প্রায় ৭৭ কিমি (৪৮ মাইল) দূরে, একদল মব এক মসজিদে আগুন লাগিয়েছে এবং পাশের জেলায় একজন তরুণ ইমাম কে গুলি করে মেরে ফেলেছে

এই রক্তদাগ ভারত — এবং ভারতীয়দের কয়েক দশক ধরে হানা দেবে।

৯০ বছর আগে ১০ই মে, ১৯৩৩। বার্লিনের বেবেলপ্লাটজে নাৎসি ছাত্রসংঘের ৫০০০ ছাত্র ও অধ্যাপকগণ জড়ো হয়েছিল। তারা প্রায় ২০,০০০ বই, পুড়িয়ে দেয়। যা বেশিরভাগ ইহুদি লেখকদের এবং কমিউনিস্ট চিন্তকদের লেখা ছিল। যেমন কার্ল মার্কস এবং রোজা লাক্সেমবার্গ — যাদের দুজনেই ইহুদি বংশোদ্ভূত ছিলেন। ৪০,০০০ জার্মান সেদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই ঘটনাটি দেখেছিল।

নাৎসি ছাত্ররা তাদের মন্ত্র পড়তে লাগল: "অধোগতি এবং নৈতিক পতনের বিরুদ্ধ! পরিবার এবং জাতির উন্নতি এবং শৃংখলার জন্য! আমি আগুনে পোড়াই লেখকের লেখা......"

পুড়তে থাকা বইয়ের এক লেখক এরিক কাস্টনার, এই ঘটনায় সেখানে লুকিয়ে ছিলেন। পরে তিনি ঘটনাটিকে শ্মশানঘাটের  সঙ্গে তুলনা করেন। দিনটি ছিল অন্ধকারচ্ছন্ন মেঘলা, বৃষ্টি বারবার আগুন নিভিয়ে দিচ্ছিলো। তাই বইগুলির মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত নাৎসি ছাত্ররা প্রচুরভাবে জ্বালানি তেল ঢালতে থাকে। 

এই ঘটনাটি মনে করিয়ে দেয় যখন এপ্রিলে বিহার রাজ্যের বিহার শরীফ নগরীতে এক প্রাচীন মাদ্রাসা ও হাতে লেখা ইসলামী পুঁথি, সহ মোট ৪,৫০০ বইয়ের গ্রন্থাগার জ্বলিয়ে দেয়। এই গ্রন্থাগার ছিল ১১৩ বছর পুরানো এবং সেখানে  সংরক্ষণ করা ছিল অমূল্য সব সংকলন। সেখানেও আক্রমণকারীরা লাঠি, পাথর এবং পেট্রল বোমার সহ প্রস্তুত ছিল।

নাৎসিদের হিংস্রতার সামনে কাস্টনার এবং তাঁর মতো লেখক এবং শিল্পীরা জার্মানি ছাড়তে বাধ্য হন। যেভাবে আজ ডানপন্থী রাজনীতিবিদরা খোলামেলা ভাবে ইতিহাসবিদদের এবং সাংবাদিকদের ভারত ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দেয়।

জার্মানিতে ২০২৩ সালের ১০মে, নয়জন অসাধারণ শিল্পী কাস্টনার এবং কার্ট টুকলস্কির মতো লেখকদের যাঁদের বই পড়ানো হয়েছিল তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে। সেই বেবেলপ্লাটজের সরাসরি নীচে এখন একটি গ্রন্থাগার স্মৃতিস্তম্ভ আছে যেখানে খালি তাকগুলোয় প্রায় ২০,০০০ বইয়ের জন্য জায়গা রাখা আছে। এখানে একটি ব্রোঞ্জ প্লেটও রয়েছে যেখানে খোদাই করা রয়েছে:

এখান থেকে শুরু; যেখানে তারা বই পোড়ায়, পরে তারা মানুষও পোড়াতে দ্বিধা করেনি। - হেনরিক হাইন, ১৮২০

ভারতে ঘটেছে উল্টো। আমরা আগে মানুষ পুড়িয়েছি পরে বইগুলি। ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদের ধ্বংসের পর মুম্বাইতে হয় দাঙ্গা। ২০০২ সালে গুজরাটে ঘটে হত্যালীলা। গুজরাটের একজন মায়ের সাক্ষাৎকারে বর্ণিত হয়েছে কীভাবে তারা তাদের প্রতিবন্ধী ছেলেকে একটি গাছের সাথে বেঁধে পিটিয়েছে। সে পানির জন্য কাঁদলেও তাকে খাওয়ানো হয়েছে পেট্রল। তারপর একটি ম্যাচেরকাঠি দিয়ে তাকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এবং সে বোমার মতো বিস্ফোরিত হয়। এই নৃশংসতার দৃশ্য মা মোকাবিলা করছেন প্রতহ্য। অথচ হত্যাকারীদের তা আদৌ মনে পরে কিনা সন্দেহ। তারা কী ঘুমোতে পারে ঠিকমত? 

হলোকস্টের ইহুদিদের পরিবহন করার জন্য রেলগাড়িগুলি বেশ কয়েকটি স্টেশনে থামে, যেখানে গরুর খাঁচার মধ্যে থাকা বুড়া, মহিলা এবং শিশুরা পানির জন্য কাঁদতে থাকে। বাসা থেকে ধরে এনে বৃদ্ধ লোকদের সড়কে গুলি করে মারা হয়েছিল। জার্মানরা সকলে এটি দেখেছিল। কী অনুভব করেছিল তারা?

আজ সেসব স্মৃতি জার্মানিরা কিছুটা হলেও অনুশোচনায় স্মরণ করে। দেশের বর্তামান প্রজন্ম সর্বত্র তা স্মরণ করে। — পুলিশ স্টেশন, যেখানে স্টাসি অভিযোগীদের গুম করে দেওয়া হতো, একটি হাসপাতাল, যেখানে রোমা শিশুদের হত্যা করা হতো, ইহুদিদের বাড়ি, গ্যাস চেম্বারগুলি সবকিছু স্মৃতিফলকে পরিণত করা হয়েছে। 

ভারতে কখনও এই ধরনের কোনো স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়নি। ভারত-পাকিস্তান নতুন রাষ্ট্র গঠনের সময় প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষ হত্যা করা হয়েছিল এবং ১৫ মিলিয়ন মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। 

আমরা কোনও প্ল্যাক প্রস্তুতিকরণ বা স্মৃতিস্তম্ভ করেছি? নেই, আছে কেবল স্মৃতি। এই মনে থাকা স্মৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রচারিত করা হয়।

জার্মানিতে একটি ইহুদি ব্যবসায় আক্রমণ এবং তাদের পেশাজীবনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে শুরু হয়েছিল, তারপর ইহুদি সম্পত্তি এবং বাড়ি দখল করার মধ্যে বৃদ্ধি পায়, কিন্তু খুব শীঘ্রই তাদের ঘেট্টোগুলিতে পাঠানো হয়েছিল, পরবর্তীতে জেনোসাইড। এই সময়ে জার্মানরা যারা এগুলো দেখেছিল তারা কী এটি বন্ধ করতে পারত না?

ভারতে, আমরা লক্ষ্য করছি যে হিন্দুদের প্রাচীন গরিমা মুসলিম রাজারা ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। যেহেতু মুসলিম রাজা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে, তার ফলে সমকালীন ভারতের উন্নতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে— মুসলিমরা যারা দেশের বৃহত এক জনগোষ্ঠী, করোনোভাইরাসের প্রকোপ, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি সব মুসলিমদের দোষ। মুসলিম শরণার্থী রোধ করার জন্য সংশোধনী আইনের পরিবর্তন, রাজপক্ষ কোনোকিছুই বাদ রাখেনি।

নতুন প্রজন্মের মুসলিম নারী-পুরুষ আধুনিক ভারতের উন্নতিতে অংশ নিতে চায়। কিন্তু সম্প্রদায়িক মুসলিম নেতা ও উগ্রহিন্দুত্ববাদীরা তাদের অন্যরকম সংজ্ঞায়িত মুসলিমত্ব বাস্তবায়িত করতে বলে। এতে করে সাধারণ মুসলিমদের — যুবক, শিশু, নারী, পুরুষ এবং পেশাদার ব্যক্তিদের — কথাগুলি হারিয়ে যায়।

হলোকস্টের পর অনেক দশক পার হওয়ার পরও, জার্মানি এখনো তার ইতিহাসের দায় বহন করে চলেছে। আমরা ভারতীয় ইতিহাস যাপন করছি, এখানেই সেই ইতিহাস। এটি পরিবর্তন করার জন্য খুব দেরি হয়েছে কি? নাকি সে দায়বদ্ধতা আমরা নতুন প্রজন্মের হাতেই ছেড়ে দেবো? 

অনুবাদ রিটন খান

Post a Comment

0 Comments