Ticker

6/recent/ticker-posts

গোলাম আযমের শাস্তি ও আদালতের করুণা - মফিদুল হক

মফিদুল হক
নিম্নের লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক প্রথম আলোতে, আমরা সেই লেখাটির আবার আমাদের সাইটে প্রকাশিত করলাম এই চিন্তা করে যে অনেকের হয়তো এই লেখাটি পড়া হয়ে ওঠেনি। মফিদুল হকের এই লেখাটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
১৯৭১ সালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোলাম আযম আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন প্রায় ৪০ বছর পর। গণহত্যার মতো নৃশংস ও নির্মম, ভয়ংকর ও ব্যাপক অপরাধযজ্ঞ যারা ঘটায়, তাদের ন্যায়বিচারের সম্মুখীন করানো বিশ্বসমাজের অন্যতম প্রধান দায়। নবপ্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ গ্রহণের পাশাপাশি অনুমোদন করেছিল জেনোসাইড কনভেনশন, যেখানে সংজ্ঞায়িত হয়েছিল গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণহত্যা প্রতিরোধ যে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত, তার এমন কাকতালীয় ও ঐতিহাসিক স্বীকৃতির পরও বিশ্বসমাজ অচিরেই এ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
স্নায়ুযুদ্ধে বিশ্ব হয়ে পড়েছিল বিভাজিত, ফলে গণহত্যা প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস নেওয়ার কোনো সম্ভাবনাই আর রইল না। আর এমনই পটভূমিকায় বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যা, বিশ্বব্যাপী এমন প্রচার ও পর্যালোচনা সত্ত্বেও, রয়ে গেল বিচারের ধারার বাইরে, আন্তর্জাতিক কোনো উদ্যোগ গ্রহণের সম্ভাবনাহীন। তবুও তো যুদ্ধবিধ্বস্ত নিঃসঙ্গ বাংলাদেশ লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বিসর্জন ও কোটি মানুষের জীবন তছনছ করে দেওয়া গভীর ও ব্যাপক নিষ্ঠুরতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের সম্মুখীন করার দাবি কখনো ত্যাগ করেনি। এই লক্ষ্য পূরণে ১৯৭৩ সালে নবগঠিত সংসদ প্রণয়ন করল ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট’ নামে আইন এবং সংবিধানের প্রথম সংশোধনী দ্বারা এই আইনকে দেওয়া হলো সুরক্ষা। ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীকে শনাক্ত করার পরও তাদের বিচারের সূচনা করতে পারেনি বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষভাবে পশ্চিমা ও মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর প্রবল বিরোধিতার মুখে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর পরিস্থিতি তো পাল্টে গেল আমূল, গণহত্যাকারীরা হয়ে উঠল ক্ষমতার সুরক্ষা ও সুফলভোগী এবং ক্রমপরিক্রমায় ক্ষমতার অংশী। তার পরও তো অপসৃত হয় না বিচারের দাবি, লাখো শহীদের অতৃপ্ত আত্মার হাহাকার মুছে ফেলার শক্তি তো কারও নেই। জনমানসে, বিশেষভাবে তরুণচিত্তে, সেই শক্তির উদ্বোধন ঘটিয়ে অভাবিত আন্দোলন সূচিত করলেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম, ১৯৯২ সালের মার্চ মাসে তদন্ত শেষে গণ-আদালত ঘোষণা করলেন একাত্তরে গোলাম আযম কৃত অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য। ঘাতক দল যতই মহিমান্বিত করার চেষ্টা করুক তাদের আমিরকে, একাত্তরের বর্বরতার কলঙ্করেখা তাঁর কপাল থেকে মুছে ফেলার উপায় কারও ছিল না। কিন্তু শক্তি তাদের অনেক, দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর সমর্থনে জাতির ওপর তারা চাপিয়ে দিয়েছিল বিচার থেকে অব্যাহতি বা ইমপিউনিটি। পৃথিবীর ইতিহাসে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের হোতা ও সহযোগীদের দ্বারা আরোপিত ইমপিউনিটির উদাহরণ বিশেষ নেই, কিছুটা তুলনীয় সত্তরের দশকের আর্জেন্টিনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের হোতা জেনারেলদের বলপূর্বক সংবিধান সংশোধন করে আরোপিত অব্যাহতি এবং চিলির সামরিক শাসক জেনারেল পিনোশে কর্তৃক অবসর গ্রহণের প্রাক্কালে আরোপিত সাংবিধানিক ইমপিউনিটি। কিন্তু গণ-আন্দোলনের মুখে তছনছ হয়ে যায় এসব অব্যাহতি, আর্জেন্টিনার জেনারেলরা দণ্ডিত হয়েছেন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে, জেনারেল পিনোশে স্পেনের আদালতে অভিযুক্ত হয়ে পালিয়ে দেশে ফিরেও রক্ষা পাননি, চিলিতে তাঁকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে দণ্ড থেকে তিনি রক্ষা পেলেও কলঙ্কতিলক চিরতরে তাঁর ললাটে অঙ্কিত হয়ে রইল।
আর অধ্যাপক গোলাম আযম! থেকেছেন পাকিস্তানে, সৌদি আরবে, ব্রিটেনে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক শাসকদের আনুকূল্যে ফিরেছেন দেশে। তার পর থেকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছেন আইন ও বিচার-প্রক্রিয়ার প্রতি। স্রষ্টার অসীম করুণা, তিনি মৃত্যুবরণ করেননি এবং ৯০ বছর বয়সে হলেও তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছে কাঠগড়ায়, শুনতে হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধের ধারাগুলো, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বহু ঘটনা আবার ফিরে এসেছে আদালতের কক্ষে। আর অকাট্য এসব তথ্যপ্রমাণের মুখোমুখি হয়ে তাঁর পক্ষের কৌঁসুলিরা, তাঁদের কেউ অস্বীকার করেননি একাত্তরে দেশজুড়ে সংঘটিত হয়েছিল নিষ্ঠুরতম বর্বরতা, ৩০ লাখ মানুষের জীবনহানি ঘটেছিল, এক কোটি মানুষ তাদের ভিটেমাটি থেকে শুধু নয়, দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল, তিন লাখ মা-বোন যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন তাঁরা, কেবল বলতে চেয়েছেন তাঁদের মক্কেল এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সঙ্গে দেশে দেশে প্রচলিত আইনে ফারাক অনেক। সাধারণ হত্যা মামলায় যেসব তথ্যপ্রমাণ প্রয়োজন হয়, এখানে তা বিশেষভাবে শিথিল। অন্যদিকে অপরাধীর সম্পৃক্ততার প্রশ্নে এই আইন অনেক কঠোর। যদি ঘটে থাকে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ, তবে অভিযুক্তের বা প্রকৃত হোতা ও যোগসাজশকারীর পার পাওয়ার বিশেষ উপায় থাকে না। আর তাই অন্যান্য আদালতে দেখা গেছে, অভিযুক্তের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা নেওয়া হয় এ কথা বলে, গণহত্যা যে ঘটছে তা অভিযুক্ত জানতেন না। গোলাম আযমের ক্ষেত্রে এমন বলার অবকাশ ছিল না, অপরাধী নিজেই তাঁর স্বীকারোক্তি রেখে গেছেন আত্মস্মৃতিতে, রায়ে বিজ্ঞ বিচারক সেখান থেকে পাঠ করলেন। ২৭ মার্চ ১৯৭১ কারফিউ শিথিলের পর গাড়ি নিয়ে শহর ঘুরে বর্বরতার পরিচয় পেয়ে শিহরিত হওয়ার কথা লিখেছেন গোলাম আযম স্বয়ং। তার পরও ৪ এপ্রিল তিনি সদলে সাক্ষাৎ করলেন কসাই জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে, গঠন করলেন তথাকথিত শান্তি কমিটি, সমর্থন জোগালেন রাজাকার বাহিনী গঠনে এবং দলের তরুণ ক্যাডারদের নিয়ে তৈরি করলেন গুপ্তঘাতক দল আলবদর, আলশামস।
জেনোসাইডের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে কোনো ধর্মীয়, নৃতাত্ত্বিক বা জাতিগোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসের লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত আক্রমণাভিযানের কথা। পাকিস্তানি বাহিনী যে জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালি এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায়কে ধ্বংসের লক্ষ্যে আক্রমণ পরিচালনা করেছিল, তার ঐতিহাসিক পটভূমি ও বাস্তবতা রায়ে বিশেষভাবে মেলে ধরেন বিজ্ঞ বিচারকেরা। এ ক্ষেত্রে গোলাম আযমের ভূমিকা ছিল ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার এবং উসকানির। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে গণহত্যার পরিকল্পনা করা কিংবা গণহত্যায় উসকানি অথবা সহায়তা প্রদান গণহত্যাকারীর সম-অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। গোলাম আযমের বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতি, আদালতে যা পেশ করা হয়েছিল, সেখানে গণহত্যার ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ ও উসকানির এমন সব নিদর্শন ছিল যে তাঁর পক্ষের কৌঁসুলিদেরও বিশেষ কিছু বলার ছিল না। তাঁরা ক্ষীণ স্বরে বলার চেষ্টা নিয়েছিলেন যে ‘হানাদার’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘দুষ্কৃতকারী’ এসব বলতে গোলাম আযম অস্ত্রধারী গোষ্ঠীকে বোঝাতে চেয়েছেন, কোনো জাতিগোষ্ঠী বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নয়। কিন্তু সুস্পষ্টভাবে হিন্দুধর্মীয় গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করে কিংবা পাকিস্তানের মতাদর্শে বিশ্বাসহীনদের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করে তাঁর প্রদত্ত বিভিন্ন বক্তব্য রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
এখানে স্মর্তব্য, রুয়ান্ডার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার উসকানিদানের জন্য রেডিও রুয়ান্ডার পরিচালক অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হয়েছিলেন, রেডিও রুয়ান্ডা তাদের প্রচারণায় সরাসরি বলেনি টুটসিদের হত্যা করো, বলেছিল তেলাপোকাদের পিষে মারো এবং এই সাংকেতিক ভাষার অর্থ ও আহ্বান হুটুদের কাছে ছিল পরিষ্কার, তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল টুটসিদের ওপর, সংঘটন করল নিষ্ঠুরতম গণহত্যা।
একটি বিশেষ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে গোলাম আযমের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছেন আদালত এবং যথাযোগ্যভাবে একে একটি বিশেষ হত্যাকাণ্ড হিসেবে না দেখে বিবেচনা করেছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের অংশ হিসেবে। ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ অভিধাটি প্রচলিত আইনে নেই, ফলে এ নিয়ে অনেক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। হত্যা, পীড়ন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, নির্যাতন ইত্যাদি বহু ধরনের অপরাধ মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়। তবে এর পটভূমিকায় থাকে ‘সাধারণ নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে ব্যাপক ও সংঘটিত আক্রমণ’ তথা ‘ওয়াইডস্প্রেড অ্যান্ড সিস্টেমেটিক অ্যাটাক এগেইনস্ট সিভিলিয়ান পপুলেশন’।
এস আই সিরু মিয়া এবং তাঁর কিশোরপুত্র আনোয়ার কামালের বন্দিত্বের খবর গোলাম আযম জেনেছেন এবং তাঁদের হত্যায় প্ররোচনা জুগিয়েছেন—এসবের সাক্ষ্যপ্রমাণ শেষে রায় প্রদানকালে বিজ্ঞ আদালত দেশব্যাপী নয় মাসজুড়ে সংঘটিত হত্যা তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের নিরিখে একে প্রতিস্থাপন করেছেন এবং এভাবেই একটি হত্যার মধ্য দিয়ে লাখো হত্যার দায় অভিযুক্তের ওপর বর্তেছে। সাধারণ নিরীহ বাঙালিরা নয় মাসজুড়ে যে সংঘটিত হত্যা ও পীড়নের শিকার হয়েছিল, তার অংশ ছিল সিরু মিয়া ও আনোয়ার কামালের শাহাদতবরণ।
আদালতে সর্বোপরি যে বিষয়টি উল্লিখিত হয়, যা প্রচলিত কোনো দেশীয় আইনে সেভাবে নেই, তা হলো সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি বা ঊর্ধ্বতন দায়ভার। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ভয়ংকরতম ও নিষ্ঠুরতম ব্যাপকভিত্তিক অপরাধ মোকাবিলার লক্ষ্যে, তথা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে সুচিন্তিতভাবে প্রণীত হয়েছে এবং তার প্রতিফলন এখানে মেলে। এটা স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া হয় যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে বিশাল আয়োজন দরকার হয়। এর মতাদর্শিক পটভূমি তৈরি, ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রচার, অপর পক্ষ নির্মূলে মতান্ধ বাহিনী তৈরি, তাদের পরিচালনা, ধ্বংসযজ্ঞে উসকানি, সহায়তা প্রদান ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যাপকভিত্তিক তৎপরতা এখানে অপরিহার্য। এর যে ক্ষেত্রে যার সম্পৃক্তি, তারা সবাই মিলে তৈরি করে জয়েন্ট ক্রিমিন্যাল এন্টারপ্রাইজ। আর এ ক্ষেত্রে সামরিক কর্তৃপক্ষের মতো বেসামরিক
নেতৃত্বের থাকে ঊর্ধ্বতন দায়ভার এবং একাত্তরে গণহত্যায় এমনি সিভিলিয়ান সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির অঙ্গুলি নির্দেশিত হয় জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযমের ওপর। এই সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির দায়ভার তথা গণহত্যার পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ, সহযোগিতা ইত্যাদির দায়িত্ব তিনি এড়াতে পারেননি। তদুপরি আন্তর্জাতিক আইনে এটাও উল্লিখিত হয়েছে যে এমনি দায়ভার যাদের ওপর অর্পিত হয়, তারা যদি তাদের অধীনদের অপকর্ম রোধে ব্যবস্থা না নেয়, তবেও তারা দোষী সাব্যস্ত হবে।
এই সবকিছুর নিরিখে বিজ্ঞ আদালতের বিচারে একাত্তরে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের ঊর্ধ্বতন দায়ভার গোলাম আযমের ওপর অর্পিত হয়েছে এবং নয় মাসব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে নিষ্ঠুর হত্যা, রক্তপাত, পীড়ন ও নির্যাতনের দায়ে তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন এবং আদালতের বিচারে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এই সমুদয় সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আদালত মনে করেছেন, গোলাম আযমের অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য। রায়ের এই শেষেরও আরেকটি শেষ রয়েছে। বিজ্ঞ আদালত অভিযুক্তের বয়স এবং শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে করুণার প্রকাশ ঘটিয়ে শাস্তি লঘু করে বিভিন্ন অপরাধে তাঁকে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন।
গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ যারা সংঘটিত করে, তাদের ক্ষেত্রে বয়স বা স্বাস্থ্যবিচারে আদালতের করুণা প্রদর্শনের উদাহরণ রয়েছে কি না, আমাদের জানা নেই। তবে এমন সব অপরাধীর ক্ষেত্রে বিশ্বসমাজের বিবেচনা যে আলাদা, তার একটি উদাহরণ এখানে পেশ করা যেতে পারে। নুরেমবার্গ ট্রায়ালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন হিটলারের দোসর, নাৎসি পার্টির অন্যতম নেতা রুডল্ফ হেস। তিনি ১৯৪১ সালে রহস্যময়ভাবে পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধ বন্ধের এক অননুমোদিত বার্তা নিয়ে ছোট্ট বিমানে করে ব্রিটিশ উপকূলে অবতরণ করেন। তার পর থেকে তিনি কারাগারে এবং পরে নুরেমবার্গে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের জন্য দণ্ডিত হন যাবজ্জীবন কারাবাসে। এর পর থেকে স্প্যানডাউ কারাগারে তিনি বন্দী ছিলেন অন্যান্য জার্মান যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে। একে একে অন্য সবাই মুক্তি পান, কারও কারও বা মৃত্যু ঘটে কারাগারে এবং ১৯৬১ সাল থেকে হেস হয়ে ওঠেন যুদ্ধাপরাধীদের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত এই কারাগারের একমাত্র বন্দী। কারাগারে সদাচারের জন্য তিনি সবার প্রশংসা আহরণ করেন, আত্মজীবনীতে তিনি কিঞ্চিৎ অনুশোচনাও প্রকাশ করেন, কিন্তু অব্যাহত থাকে তাঁর নিঃসঙ্গ কারাবাস। কাটতে থাকে দিন, বাড়তে থাকে তাঁর বয়স; ৮০, ৮৫, ৯০। যুদ্ধের পর কত বছর কেটে গেছে, তাঁর প্রতি করুণা প্রদর্শনের কথা কেউ কেউ বললেও, বিশ্বসমাজ সে পদক্ষেপ নেয়নি। কেননা, করুণা প্রদর্শন করতে পারেন একমাত্র গ্যাস চেম্বারে মৃত কয়েক লাখ নারী-পুরুষ-শিশু নাৎসি বর্বরতায় নিহত প্রতিরোধ যোদ্ধারা, নিপীড়িতজনেরা। আর তাই ৯৩ বছর বয়সে রুডল্ফ হেসের মৃত্যু ঘটলে কারান্তরালে ১৯৮৭ সালে, এরপর বন্ধ করে দেওয়া হলো স্প্যানডাউ কারাগার।
এখনো বেঁচে আছেন শহীদ সিরু মিয়ার স্ত্রী এবং শহীদ আনোয়ার কামালের বোন। তাঁদের কাছে এবং তাঁদের মতো আরও লাখ লাখ মা-ভাইবোনের কাছে জিজ্ঞাসা করতে হবে করুণার লেশমাত্র ছিল না যেসব গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের, তাদের যথাযোগ্য ও আদালত-নির্ধারিত প্রাপ্য দণ্ড মওকুফে আমাদের কী করণীয়?
মফিদুল হক: লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।

Post a Comment

0 Comments