Ticker

6/recent/ticker-posts

ভালোবাসা প্রীতিলতা - সেলিনা হোসেন

ভালোবাসা প্রীতিলতা - সেলিনা হোসেন ভালোবাসা প্রীতিলতা - সেলিনা হোসেন
রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এখন ফাঁসির আসামি। আলিপুর জেলে মৃত্যুকুঠুরিতে দিন গুনছে। হাইকোর্টে আপিল করা হয়েছে।
দৈনিক পত্রিকার পৃষ্ঠায় খবরটি পড়ে প্রীতিলতা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে। কোন রামকৃষ্ণ? চট্টগ্রাম কলেজে একজন পড়তেন, ভালো ছাত্র হিসেবে নাম শুনেছিল। বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করছিল রামকৃষ্ণ। কখনো দেখা হয়নি। যদি সেই রামকৃষ্ণ না হয়, তবে তো অন্য কেউ হবে। তাতে কিছু এসে যায় না। প্রিয় শহর চট্টগ্রাম। বিপ্লবীদের অনেকেই চট্টগ্রামের। যে রামকৃষ্ণই হোক, সে তার চট্টগ্রামের। প্রীতিলতা স্তব্ধ হয়ে–থাকা থেকে বেরিয়ে এসে সংবাদপত্রের অন্য পৃষ্ঠায় যায়। কিন্তু পড়া হয় না। আবার নিজের ভাবনা তাকে স্তব্ধ করে দেয়। পত্রিকা ভাঁজ করে নিজের হাতের মুঠোয় রাখে।
ওর প্রিয় চট্টগ্রামের বিপ্লবী রামকৃষ্ণের কথা ও আগে কখনো শোনেনি। নামটাও জানা ছিল না। তবু একই জেলার বলে ওকে বেশি কাছের মানুষ মনে হয়। এই অনুভব এক ধরনের হৃদয়ের বন্ধন, যে বন্ধন দিয়ে অনেক দূরের মানুষ কাছে আসে, যা নিবিড় হয়ে প্রীতি, ভালোবাসা, মমতার ঘেরাটোপ তৈরি করে। রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং ফাঁসির আসামি — এই চারটি শব্দ দৈনিক পত্রিকার পৃষ্ঠার অন্যসব অক্ষর মুছে দিয়ে বিশাল হয়ে ওঠে। শব্দগুলো পরস্পরের সঙ্গে এত গভীরভাবে জড়িয়ে আছে যে, তাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। অন্তত প্রীতিলতার দৃষ্টি থেকে কিছুতেই দূরে সরে না। ফলে প্রীতিলতা অস্থিরতা বোধ করে। মনের ভেতরে ইচ্ছার কাঠঠোকরা পাখিটা কুটকুট শব্দে ঠুকরে যাচ্ছে। বলছে, আমি ওকে দেখতে চাই। একবার, শুধু একবার দেখব। এখন এই কলকাতা শহরে আমি আছি। এত কাছে থেকে আমি যদি রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকে না দেখি, তবে নিজেকেই ক্ষমা করতে পারব না। ওকে দেখে, ওর মৃত্যুর সাহস বুকে নিয়ে ফিরে যাব চট্টগ্রামে।
নিজের এই ইচ্ছায় চমকে ওঠে ও। নিজেকে নিয়ে বিব্রত বোধ করে। তারপর নিজেকে শাসায়, এ কী ভাবছ, প্রীতিলতা! নিজে বিপ্লবী হয়ে জান না যে, গোপনীয়তা বিপ্লবীদের প্রাথমিক শর্ত।
জানি, জানি। তবু একজন মৃত্যুপথযাত্রী সাহসী মানুষকে আমার দেখতেই হবে। এইসব মানুষ হাজার হাজার জন্মায় না। এদের দেখতে যাওয়া পুণ্যের কাজ। ভগবান আমার সহায় হবেন।
প্রীতিলতা জানালায় এসে দাঁড়ায়। বাইরে খোলা প্রান্তর — যতদূর চোখ যায়, কেবলই সবুজ। হোস্টেলের মেয়েদের কথা ভেসে আসছে। যেন কলধ্বনি নয়, প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। কাছে কোথাও বোমা ফাটল বুঝি, নাকি কেউ পিস্তলের ট্রিগার টিপল। প্রীতিলতা দু-হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে। না, কোথাও তো কোনো শব্দ নেই। বাইরে পাখি ডাকছে একটি। মনে পড়ে, ছোটোবেলায় ক্ষুদিরামের কথা শুনেছিল। ক্ষুদিরাম হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে উঠেছিল। রামকৃষ্ণ কি ক্ষুদিরামের মতো মৃত্যুকুঠুরিতে বসে হাসছে? মরণ কী? মরণ কেমন? দর্শনের ছাত্রী প্রীতিলতা মৃত্যুর কথা ভেবে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিছুতেই ভাবতে পারে না যে, মরণ এক গভীর অন্ধকার। ওর মনে হয়, মরণ স্বপ্নময় জগৎ — মানুষ যে স্বপ্ন দেখে নিজে বাঁচে এবং অন্যকে বাঁচতে শেখায়, অন্তত তেমন মৃত্যু — ফাঁসির আসামি যাকে বীরের মতো বরণ করে। মৃত্যুকে জীবনের স্রোত বলা যায়। একজন থেকে আর একজনের কাছে আসে মহত্ত্বের বাণী নিয়ে। দেশের জন্য, মানুষের জন্য অবিনাশী বাণী। মৃত্যু তো ক্ষুদিরামের হাসিকে ম্লান করতে পারেনি। রামকৃষ্ণের হাসিকেও পারবে না। তখন প্রীতিলতার চোখের সামনে যতদূর দেখা যায়, সবুজ প্রান্তরটি অজস্র ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে। মৃত্যুকে ফুলের মতো দু-হাতে নিয়ে রামকৃষ্ণ হেঁটে আসছে। পত্রিকার পৃষ্ঠার এই খবর ওকে তাড়িত করে না। ও বুঝতে পারে যে, ওর এই অস্থিরতা কোনো দুঃসংবাদ শোনার জন্য নয়। এই অস্থিরতার মধ্যে প্রচণ্ড আবেগ আছে। চিত্তচাঞ্চল্যের তাড়না আছে। এই আবেগ একজন বিপ্লবী থেকে অন্য বিপ্লবীতে সঞ্চারিত হয়। ফলে যত বিপদই হোক, রামকৃষ্ণকে দেখার জন্য প্রীতিলতা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে। এই দেখা করার মধ্যে বিপ্লবীদের গোপনীয়তা রক্ষা করার শর্ত ও কোনোভাবেই ক্ষুণ্ণ করবে না।




Download and Comments/Join our Facebook Group