Ticker

6/recent/ticker-posts

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প 'থার্ড ক্লাস'

amarboi

থার্ড ক্লাস
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

জহর দাঁড়িয়েই আছে স্টেশনে। টিকিটের ঘন্টাও পড়ে গেছে। লোকজন লাইন দিয়েছে টিকিট কাউন্টারে।

সে পকেট হাতড়ে টিকিট ঠিক জায়গায় রেখেছে কি না, যদি হারিয়ে যায়, এখানে ক্রসিং আছে, সব সময় কেমন এক সন্ত্রাস যেন তাকে তাড়া করছে। সে রেলে চড়েনি, রেলে তার কোথাও যাওয়া হয়নি। ভাঙা সাইকেল তার সম্বল।

কত লোকজন প্ল্যাটফরমে, ভিড় ঠেলে লোকজন বের হয়ে আসছে, সে কাউকে চেনে না, একবারে অপরিচিত এক পৃথিবী যেন। সে যে এই প্ল্যাটফরমে একজন আগন্তুক, বুঝতেও তার কষ্ট হয় না। চায়ের স্টল পার হয়ে প্ল্যাটফরমে সামনের দিকে চলে গেলে ঠেলাঠেলি কম। বাক্সপ্যাটরাও মেলা, এমন সময় সুন্দর একটি ঘ্রাণও ভেসে এল, এক তরুণী প্রায় তার সামনে দাঁড়িয়ে, একটা অতিকার কুকুরের বকলস হাতে। চোখে কালো চশমা, তার চার পাশে যারা আছেন তারাও সবাই যেন সুমহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সে বুঝল, তার মতো একজন অকিঞ্চিৎকর মানুষ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ধমক খেতে পারে—তার ভয়ই হচ্ছিল। অস্বস্তিও আছেই, সে একা, খুবই ব্যাজার মুখে সে যেন জায়গাটা থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। কুকুরটা যে ভাবে জিভ বের করে হাহা করছে, হাত থেকে ছুটে গেলেই তার গলা কামড়ে ধরতে পারে।

নিতাই যে কোথায় গেল!

রেলের টিকিটেই মেলা পয়সা গেছে—দু টাকা দশ আনা—সোজা কথা। বাড়তি প্ল্যাটফরম টিকিট কে কাটে! প্ল্যাটফরম টিকিট কাটার কথা নিতাই-এর। প্ল্যাটফরম টিকিট কাটতে সে রাজি না।

তার এক কথা, আমি ঠিক বের হয়ে যাব। তুই ভাবিস না ত।

সে ট্রেনে ওঠার বিষয়ে কলেজ বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারত, তবে সে যে গাঁইয়া এমন প্রমাণিত হয়ে গেলে, সে শুধু নিজেকে খাটো করবে না, মা বাপও খাটো হয়ে যাবে। গরিব পিতামাতার সন্তান এটা যে সমাজ সংসারে কত বড়ো অপবাদ নিতাই বোঝেই না। জামা-প্যান্টের যা ছিরি, তাতে যে কেউ যেন নিতাইকে কান ধরে প্ল্যাটফরমের বাইরে বের করে দিতে পারে। গায়ে ন্ঠরিফিউজি গন্ধ থাকলেও হয়েই গেল, সেই ছেলে কিছুতেই প্ল্যাটফরম টিকিট কাটবে না। একতাল পয়সা বাঁচিয়ে ছোলা-মটর কিনে খেতে খেতে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি চলে যাবে। মাথায় নিশ্চয় তার এমন ফন্দি কাজ করছে।

যখন কিছুতেই রাজি না, জহর বলেছিল, দে, সুটকেস দে। ওটা আমি নিতে পারব। ট্রেন ঢুকলে তোকে প্ল্যাটফরমে থাকতে হবে না। যা বাড়ি যা।

কেন?

কেন কি আবার, হয় টিকিট কাটবি, নয়ত চলে যাবি। আমাকে রেলে চড়া তোকে আর শেখাতে হবে না। গাড়িতে আমি ঠিক উঠতে পারব। তুই যা। প্ল্যাটফরম টিকিট না কাটলে জানিস বাবুরা তোকে পুলিশে দেবে।

তুই যা বলার পরই তার কেন জানি মনে হল নিতাই চলে গেলে সে ভারি একা হয়ে যাবে।

গেল কোথায়!

সে চারপাশে খুঁজছে নিতাইকে।

নিতাই তার সুটকেস হাতে নিয়ে কোথায় যে ভিড়ের মধ্যে ঘুরছে।

এই ট্রেনটায় যে খুবই ভিড় হয় সে জানে। প্ল্যাটফরমের এ-মাথা ও-মাথা মানুষজনে গিজ গিজ করছে। অথচ প্ল্যাটফরমের এদিকটায় একেবারেই ফাঁকা। কিছু দামি বাকস-প্যাটরা সহ সেই তরুণী, এবং সাহেব সুবোর মতো কিছু ভারি সুপুরুষ দেখতে যাত্রী, মেয়েটির দিকে তাকালেই মনে হয় গোটা এলাকাটাই তাদের খাস তালুক। এদিকটা বুঝি কারও দাঁড়াবার কিংবা ঢোকবার নিয়ম নেই।

তখনই সেই তরুণী চশমা খুলে ইশারায় তাকে ডাকছে।

এইরে, খুবই বুঝি বেয়াদপি হয়ে গেছে, নিতাই যে কোথায় গেল! তার হতাশ চোখ মুখ, তারপরই দেখল কুকুরটা ছেড়ে দিয়ে তিনি এদিকেই এগিয়ে আসছেন। পরনে নীলরঙের লতাপাতা আঁকা পাতলা ফিনফিনে শাড়ি, গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে শরীর জুড়াবার পক্ষে যথেষ্ট, হাতকাটা ব্লাউজ এবং বগল তুললে, বগলের লোমও দেখা যায়, সে নিজেই কেন জানি এই অসভ্যতা পরিহার করার জন্য কিছুটা দূরে দূরে সরে দাঁড়াবার সময় শুনল, তুমি জহর না!

সে তাকায় না। কারণ তাকালে যেন সে আরও কুণ্ঠিত হয়ে পড়বে।

তুমি আমাদের বাড়িতে কাকার কাছে আসতে না?

সে ঠিক বুঝতে পারছে না, কে তার কাকা, কার কাছে সে যেত!

শোভন সোমকে চেন না! আমার কাকা, এখন দেখছি ভাজা মাছটি উলটে খেতে জান না।

তার কিছুটা হতভম্ব অবস্থায়। শোভন সোম, সে তো এলাহি বাড়ি, এলাহি প্রাসাদ!

এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কোথায় যাবে?

আজ্ঞে গাড়িতে উঠব। গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছি। সে জানে তার পোশাক আসাকে ভালো না, সে গরিব বাবার ছেলে, এখানে দাঁড়াবার বোধ হয় হক নেই তার, অথচ মেয়েটি তাকে বেশ ভালোই চেনে, অথচ সে তাকে চেনে না, কোথায় দেখেছে, তাও বুঝতে পারছে না আর এমন সুন্দর মেয়েটা তাকে কেন যে চিনতে গেল আর এখানেই বা দেখা হওয়ার কী দরকার ছিল। ট্রেনে সঙ্গে সঙ্গে উঠতে না পারলে বসার জায়গা পাওয়া যাবে না মেয়েটা বোধহয় তাও টের পেয়ে গেছে। জেলা কংগ্রেসের মুখপত্র সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রেস বয় সে। শোভন সোম, করিম সাহেবের কাছে লেখালেখির সূত্রে প্রুফের কপি নিয়ে তাঁদের কাছে তাকে ঘোরাফেরা করতেই হয়। সে যায়, তবে প্রাসাদের মতো বিশাল দু মহলা বাড়িটায় কারা থাকে সে জানেই না। তার কৌতূহলও নেই। সে শোভন সোমের কাছে যায়, কাজ হয়ে গেলে চলে আসে। বাড়ির এক তলায় একটি বড়ো হলঘরে সে দেখেছে সাদা মারবেলের টেবিলমাথার উপর ঝাড়লণ্ঠন, রিন রিন শব্দ, কিছু জালালি কবুতরের ওড়াওড়ি—আর ঘরটা এত বড়ো যে ঢুকলেই বুক হিম হয়ে যেত আর বাড়িটার উঠোনে বড়ো বড়ো টবে গোলাপ, জিনিয়া, সূর্যমুখী, টগর কত না ফুলের সমারোহ। আর তার মধ্যে কোন গাছে কী ফুল ফুটে থাকল দেখার সাহসই হত না।

সে ঘাড় গুঁজে গেটের ভেতর সাইকেল নিয়ে ঢুকে যেত।

তারপর বারান্দায় সাইকেল রেখে চুপি দিত।

তিনি আছেন।

সে বলত, কাকা আমি জহর।

এসো।

এই কবিতাটা কম্পোজে দেওয়া গেল না।

কেন?

ও হয়নি কিছু।

তিনি তার মতামতকে অগ্রাহ্য করতে পারতেন, তবে হয়নি কিছু বোধ হয় বলা ঠিক হয়নি। কিছুটা যে বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে সে তাও বুঝতে পেরেছিল। সব লেখাই সে একবার পড়ে দেখে। বানান ভুল থাকলে ঠিক করে দেয়। কিংবা গদ্য দুর্বল হলে সে তাতেও কলম চালায়। প্রাথমিক নির্বাচন বলতে গেলে সেই করে থাকে। তবে কবিতাটি ফেরত দেওয়া উচিত কাজ যে হয়নি, শোভন কাকার মুখ দেখেই সে টের পেয়েছিল।

কী হল বোসো।

সে দাঁড়িয়েই ছিল।

যদি ছাপতেই দেওয়া না যায়, তবে তুমি কী করবে।

আসলে কাগজটা যে জেলার মুখপত্র, এবং খবর কম থাকলে, কিংবা বিজ্ঞাপন কম পেলে, গল্প কবিতাও মাঝে মাঝে ছেপে দেওয়া, জায়গা ভরাট করার জন্য, তিনি ভালোই জানেন। গল্প, কবিতা সেই দেখে থাকে। কাজেই তিনি তাকে যেন বাহবাই দিলেন, যে যা দেবে তাই ছাপাতে হবে তোমাকে কে বলেছে।

সেই।

ঠিক আছে কবিতাটি ফেলে দাওনি ত!

আজ্ঞে না।

দিয়ে দেবে আমাকে। আমাকে দিল, কী করি! ওতো শুনেছি তোমাদের কলেজ ম্যাগাজিনেও লিখেছে। আমাকে পড়িয়েছে। ছন্দের মিলটিলও মন্দ না।

আপনি যদি বলেন, কমপোজে পাঠিয়ে দেব। খুবই কুণ্ঠিত চিত্তে কথাটা সেদিন সে না বলে পারেনি।

আরে না না। কবিতা বিষয়টাই আমার কাছে রাবিশ। যাকগে, প্রুফগুলো রেখে যাও।

তারপর তিনি ড্রয়ার টেনে দুটো লেখা বের করে বললেন, আমাদের জঙ্গীপুরের প্রতিনিধি লেখা দুটো পাঠিয়েছে। বের হবার সময় ফের মনে করিয়ে দিলেন, কবিতাটি ফেরত দিও। কবিতা বুঝলে না, যিনি লেখেন, তার মনে হয় ইহজন্মে আর এমনটি লেখা হয়নি। অত সোজা বলো, কবিতা লেখা—যত্তসব খেয়াল।

শোভন কাকার প্রাসাদতুল্য বাড়িটার একতলায় কেমন পাথরের মতো হিম ঠান্ডা। ঘরগুলো এত বড়ো, আর এত উঁচু ছাদ যে, সে একা ঢুকলে শরীর কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ত। কত উঁচু সেই সব বাড়িবরগা, লম্বা রডে পাখা ঝুলছে, সারা ঘরে দেওয়াল আলমারি, আর আলমারিগুলো বইয়ে ঠাসা। সবই আইনের বই, সোনার জলে বাঁধানো, কবেকার পুঁথিপত্র এবং বারান্দা ধরে এগিয়ে গেলে, কোথাও বড়ো বড়ো তৈলচিত্র—যেন শোভন সোমের একতলাটি কোনও বন্দি রাজকুমারের—যে পাথর হয়ে গেছে—কোনও সাড়াশব্দও পাওয়া যায় না। দু-একজন কাজের লোকের দেখা পাওয়া যায়, তারা, দেয়াল কিংবা জানালা, মেঝে পরিষ্কার করছে, বাগানে দু-একজন মালিও দেখা যায়। কাজ করে যাওয়া নীরবে, একতলায় ঢুকলে তার এমনই মনে হত।

আর দোতলার দিকে অবশ্য সে চোখ তুলে তাকাত না।

কারণ সেখানে সব পরির মতো মেয়েদের মুখ দেখা যায়, এক সময় চারপাশে চিক ফেলা থাকত তাও বোঝা যায়। তবে সেই চিকের বাহার না থাকলেও নারীকণ্ঠে সরগরম হয়ে থাকে বারান্দা। কোথাও কেউ নাচছে, কেউ গাইছে, কেউ ছুটছে।

তার যে কৌতূহল নেই বলা যাবে না।

তবে সে দোতলার দিকে চোখ তুলে কখনও দেখে না।

কে দৌড়ায়, কে সিঁড়ি ধরে লাফিয়ে নামে দেখা তার কখনও হয় না।

চোখে চোখ পড়ে গেলে কী যে ভাববে!

সে বাড়িটায় গেলে সুন্দর ঘ্রাণ পায়।

শোভনকাকার ভাইঝি কি সেই কবি! মেলা ভাইঝি, সারাক্ষণ ওপরে কিচির মিচির শব্দ, শোভন কাকার দাদা-কাকাও থাকতে পারে, কাকিমা-দিদিমাও থাকতে পারে—মেলা ঘর, মেলা মানুষজন—আর ঠাকুর, চাকরতো আছেই—কোনও ঘরে ক্যারাম খেলা হচ্ছে, সে তাও টের পেত।

তার একবার বলার ইচ্ছে ছিল, তোমার নাম।

তোমার বলা কি ঠিক হবে।

প্রাসাদতুল্য বাড়িটার দোতলায় মেয়েটির মুখ সে কখনও দেখেছে বলেও মনে করতে পারে না—আর যা হয়, বাড়ির মেয়েদের সবারই যেন নীলাভ চোখ—দেখলে সব মেয়েদের একই রকমের মনে হয়।

জহর কত কিছু যে ভাবছে।

সারা প্ল্যাটফর্মের যাত্রীর এত ভিড়, অথচ এদিকটায় ফাঁকা কেন সে বুঝতে পারছে না।

গরমে সে হাসফাঁস করছিল।

কপালে ঘাম, সে নিতাইকে খুঁজছে। প্ল্যাটফরম টিকিট কাটতে এত সময় ত লাগার কথা না।

তখন আবার কথা শোনা গেল। কারণ উঁচু লম্বা মেয়েটি তার দিকে তাকিয়েই আছে।

তোমার সঙ্গে আর কেউ কি আছে?

জহর আছেও বলতে পারে, আবার নেইও বলতে পারে।

কী বলবে বুঝতে পারছে না।

তারপর অনেক কিছু ভেবে বলল, আছে।

সে কোথায়?

প্ল্যাটফরম টিকিট কাটতে গেছে।

গাড়ি আসারও ঘন্টা পড়ে গেল।

তাই তো, কী যে করি!

এখানে দাঁড়ালে উঠবে কী করে! দেখছ না কী ভিড়!

তার বলার ইচ্ছে হল, তুমি উঠতে পারলে আমি কেন উঠতে পারব না।

মেয়েটি কী বুঝে কাকে ডাকল।

বেশ একজন মনোরম যুবক কাছে এসে বলল, একে চেন?

কে?

জহর সেন।

কী হবে তাঁকে দিয়ে। তাঁকে চিনে।

কিছু হবে না, আখেরে কাজে লাগতে পারে। গণরাজ কাগজের গল্প-কবিতা দ্যাখে। নিজেকে খুব বেশি বোদ্ধা ভাবে।

জহর বলল, আমি আসি।

সে কেমন ভর পেয়ে গেছে। তার উপর মেয়েটি কেন যে এত খাপ্পা হয়ে গেল, মেয়েটি গরমে যে কাহিল তাও বোঝা যায়, স্বল্পবাস এবং হালকা শাড়ি সায়া পরে দাঁড়িয়ে থাকায় অবশ্য সে কন্ঠবার তাকে দেখার যে চেষ্টা করেনি, তা নয়, তবে এ-জন্য এত খাপ্পা হওয়ার কথাও না, মেয়েদের দিকে অসভ্যের মতো তাকিয়ে থাকলে রাগ হবারই কথা। সে যখন এইসব ভাবছিল, তখনই মেয়েটি বলল, যেই থাকুক, এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকো না। ট্রেন ফেল করবে বলে দিলাম। বেশি বোদ্ধা হলে শেষে পস্তাতে হয়।

ট্রেন ফেল করবে কেন, সে বুঝতে পারছে না।

তখনই সুচারু এক মুখের বয়স্ক মহিলা ডাকছে, এই প্রীতি ওখানে কার সঙ্গে কথা বলছিস!

মেয়েটি সহজভাবেই জবাব দিল, জহরের সঙ্গে—গণরাজ কাগজে কাজ করে। আমাদের বাড়িতে কাকার কাছে আসে। কাগজের প্রেসবয়।

প্রীতি!

প্রীতিলতা—

নামটা মনে পড়েছে।

প্রীতিলতা সোম। সুযোগ পেয়ে যথেচ্ছ উপহাস প্রীতিলতার, সে প্রেসবয়, সে বেশি বোদ্ধা—একজন তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীর পক্ষে যে এটা শোভা পায় না তাও আভাসে ইঙ্গিতে বলে দিল।

প্রীতি তাঁকে দেখেছে, সে তাঁকে দেখেনি। প্রীতিলতা তাঁকে বিলক্ষণ চেনে।

মেয়েটা যে কী! সে যখন প্রীতির এত চেনা, কবিতা তার হাতে দিলে কী ক্ষতি ছিল—মেয়েটা জানে না, কবিতা হোক, গল্প হোক কিংবা কোনও জঙ্গীপুর সংবাদদাতার লেখাও সে ঠিকঠাক করে দেয়—প্রীতির কাকা কিংবা মামা যেই দিক, শেষ পর্যন্ত লেখাটি তার হেফাজতেই চলে আসবে।

অবশ্য ভাবতে পারে তার কাকা শোভন সোম জেলার প্রভাবশালী মানুষ, কাগজের অন্যতম সম্পাদক শহরের বনেদি পরিবারের মেয়ে প্রীতি, তার পক্ষে এক চালচুলোহীন যুবকের হাতে কবিতা দেওয়া যে আদৌ শোভন নয়, প্রীতির দোষও দেওয়া যায় না, আর সে জানতও না, শোভনকাকার ভাইঝি প্রীতি জানলে সে কখনওই কবিতাটি ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিতে সাহস পেত না।

আশ্চর্য সেই মানুষটি। কবিতাটি কম্পোজে না দেওয়ায় বিন্দুমাত্র তিনি বিরক্ত হননি। বরং সে ঠিক কাজই করেছে, কাকার আচরণে এমনই মনে হয়েছিল তার, কেবল ফেরত দেবার কথা ছাড়া আর কোনও কথা হয়নি।

সে যথাসময়ে কবিতাটি শোভন সোমকে ফিরিয়েও দিয়েছিল—

কবিতার দুটো একটা লাইনও সে মনে করতে পারছে। কিছুটা অশ্লীলতার গন্ধ আছে বলেই কবিতার কিছুটা মনে করতে পারছে।

ঘুম আসছে না।

আসে না ঘুম।

আগুন জ্বলে শরীরে—

ভারী আগুনের ভিতর

থাকি বসে।

আমার শরীর আলগা

হয়, হয় বেদনার ঝুড়ি

সব খুলে নিলে আরাম

এবং শান্তি।

শরীর আগুন হয়ে

থাকে ...

না আর মনে পড়ছে না।

আসলে কবিতাটিতে আছে মধ্যরাতে নারীর ঘুম ভেঙে গেলে যা হয়।

জল তেষ্টা পায়।

শরীর কোনও কারণে বিবশও হতে থাকে। ঘরে একা থাকলে যাবতীয় পোশাক-আসাকে আগুন ধরিয়ে বসে থাকার ইচ্ছে হয়, হয়তো। এবং কোনও নগ্নতার যে আভাস ছিল কবিতায়, সে তা বোঝে।

কবিতাটি ভালো কি মন্দ সে বিচার করার অধিকার যে তার নেই জহর ভালোই জানে। তবে একটি জেলার সংবাদপত্রে কবিতাটি ছেপে দিলে, জ্ঞানকাকা বিরক্ত হন যদি, কিংবা অহিকাকা, যেন কবিতাটি ছেপে দিলে সেও কম সেয়ানা নয় এমন সবাই ভাবতেই পারে।

অথবা জ্ঞানকাকা বলতেই পারেন, কাগজটায় ছাইপাঁশ কেন যে ছাপিস।

কিংবা নিরঞ্জনকাকাও বলতে পারেন, জহর কি আছে রে কবিতায়। আমাকে বুঝিয়ে দে। তুই যে ছাপতে দিলি, তোর কি একবারও মনে হয়নি শ্যামাদা কাগজটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। রক্ষণশীল মানুষ, কবিতাটি পড়লে তিনি বিরক্ত হতে পারেন।

জেলা কংগ্রেসের সভাপতি শ্যামাপদ ভট্টাচার্যকে সে অফিসে প্রায়ই দেখে থাকে। বড়োই দীর্ঘকায় মানুষ, এবং এমন সুপুরুষ সে জীবনে কমই দেখেছে। ঈগল পাখির মতো নাক তাঁর, আর গৌরবর্ণ এবং সে তাঁর বাড়িতেও গেছে। জেলায় সব গণ্যমান্য মানুষের ভিড়, এবং সে প্রায় চোরের মতো বাড়ির ভিতর ঢুকে যেত, যেন ধরা পড়লেই তাঁকে কৈফিয়ত দিতে হবে। পুত্রদেরও সে দেখে থাকে, সবাই প্রায় দীর্ঘকায় এবং শোভনকাকার বাড়ির মতো এ-বাড়িটায় ঢুকলেও প্রাচীন বনেদিয়ানার গন্ধ পায়।

এইসব কথা কেন যে দ্রুত সে ভেবে ফেলতে পারছে, আর চারপাশে খুঁজছে শয়তানটিকে। গাড়ি আসার সময় হয়ে যাচ্ছে। কোথায় যে গেল নিতাই! প্রীতি তাঁকে দেখে কিছুটা যেন মজা ভোগ করছে, তার এই অসহায় অবস্থা যেন কবিতাটি না ছাপার দুর্ভোগে পড়ে রয়েছে। সে কিছুটা সরেও গেছে, কিন্তু প্রীতির চোখ সে এড়াতে পারছে না। প্রীতির সঙ্গে তার আত্মীয়স্বজনও আছে—গাড়িতে তুলে দেবার জন্য সঙ্গে কাজের লোকেরও যে অভাব নেই—যেন এই প্ল্যাটফরমের সব যাত্রীরাই সোমবাড়ির মেয়েবউরা কলকাতায় যাচ্ছে বলে দর্শনীয় কোনও ঘটনার জন্ম দিচ্ছে।

সে বড়োই ফাঁপড়ে পড়ে গেল।

তখনই প্রীতি প্রায় চিৎকার করে বলল, আরে করছ কী, এটা তোমার দাঁড়াবার জায়গা নয়। ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড ক্লাস কামরা এখানে দাঁড়ায়। শিগগির পিছনে দিকে চলে যাও। দেখছ না হুড়মুড় করে সব ছুটছে। পেছনে ছুটে যাও। সামনের দিকেও ছুটতে পার। আচ্ছা একটা ক্যাবলাকান্ত—না পারা যায় না!

আসুক নিতাই। ক্ষোভে জহরের মেজাজ বিগড়ে গেছে। যেন নিতাইকে পেলে এই প্ল্যাটফর্মে ফেলেই একচোট পেটাবে। সে ক্যাবলাকান্ত! ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড ক্লাস কামরার সামনে তাঁর দাঁড়াবার অধিকার নেই।

ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড ক্লাসের কামরাগুলি কোথায় থামে সে তাও জানে না। থার্ড ক্লাসের যাত্রী সে। থার্ড ক্লাসের যাত্রীর পক্ষে এর চেয়ে ভালো বোকামি বোধ হয় আর হয় না। সে গাড়ি ফেল করতে পারে, ভিড়ের ট্রেনে গাড়িতে ওঠাই কঠিন। প্রীতি তাঁকে তাড়া লাগাচ্ছে—আরে এখানে নয়, ওদিকে, পেছনে ছোটো। শিগগির ছোটো।

কবিতা তো অনেক দূরের ব্যাপার, থার্ড ক্লাসে ওঠার বিষয়টাই সে জানে না, সে যে খুবই অর্বাচিন আভাসে ইঙ্গিতে তাও বোধ হয় বুঝিয়ে দিতে চায়। আসলে এটা যে কত বড়ো অপমান নিতাই যদি বুঝত। তুই বুঝবি না, আমি একা থাকলে ঘাবড়ে যাই। ভিড়ের মধ্যে তুই হারিয়ে গেলি। আর সে তখনই দেখল দূরে সিগনালের ওপারে গাছপালার ভেতর দিয়ে রেলগাড়ি এগিয়ে আসছে। ইঞ্জিনের ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। এবং গাছপালার মধ্যে ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে। বড়ো স্টেশন বলে গাড়িটা এখানে মিনিট দশেক দাঁড়ায়। কামরার ভিতর ঢুকতে না পারলেও দাঁড়িয়ে ঠিক চলে যেতে পারবে। সে যেন কিছুটা সাহস ফিরে পেল।

সিট দখলের জন্য ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। সে কোনদিকে যাবে তাই বুঝতে পারছে না। নিতাই না এলে সে যেতেও পারছে না। নিতাই এখানে এসেই তাকে খুঁজবে। সে ঠিক আসবে—তারপর ধীরেসুস্থে যে করেই হোক ট্রেনে ওঠা যাবে। তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই। বসার জায়গা না পেলেও তার চলবে।

প্রীতি যেন তার ওপর আরও বেশি খেপে যাচ্ছে। ট্রেন ইন করছে, অথচ কোনও হুঁশ নেই, দাঁড়িয়েই আছে, তাঁকে আহাম্মকও ভাবতে পারে, ভাবুক, যা খুশি ভাবুক। সেও কেমন এক ধরনের মজা ভোগ করতে থাকল। ট্রেন ইন করছে, কামরায় ওঠার জন্য হুড়োহুড়ি মারামারি শুরু হয়ে গেছে। জানালা দিয়ে কেউ বাক্স, রুমাল, কাগজ যে যা পারছে ছুঁড়ে দিচ্ছে। প্রীতির আত্মীয়স্বজনরাও সামনের কামরায় উঠে গেল। কুকুরটাও লাফিয়ে কামরায় উঠে গেল, প্রীতির সেই যুবক চেঁচাচ্ছে—আরে উঠে এসো। দাঁড়িয়ে থাকলে কেন!

কিন্তু প্রীতি উঠছে না।

জহর কিছুটা যেন জয়লাভ করার স্পৃহাতে মরিয়া হয়ে উঠল।

আপনি উঠে পড়ুন। আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবেন না। নিতাই এলেই আমি ঠিক উঠে পড়ব। আরে দাঁড়িয়ে থাকবেন কেন?

প্রীতি যে তার বোকামিতে খেপেই আছে —আমার খুশি। তারপরই প্রীতি কেমন কিছুটা হাঁপিয়ে ওঠার মতো বলল, ট্রেন ছাড়তে দেরি নেই। এসো আমার সঙ্গে, প্রায় যেন জোর করে তাঁকে তাঁরা কামরায় তুলে নিয়ে যাবে। আর তখনই দাদা রে দাদা রে বলে কেউ ডাকতে ডাকতে এদিকে আসছে। সে বলল, নিতাই আসছে। আপনি উঠে পড়ান।

শিগগির চলে আয় দাদা। একেবারে জানালার ধারে সিট। সুটকেস রেখে এসেছি। পাশের লোককে বলে এসেছি, আমার দাদার সুটকেস। দাদা কলকাতা যাবে। নিতাইকে অনুসরণ করার আগে সে প্রীতির কাছে গেল—বলল, উঠে পড়ুন, আর দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে! ওই দেখুন ভেতর থেকে কুকুরটা গলা বাড়িয়ে আপনার জন্য ভুক-ভুক করছে। খুবই বিচলিত বোধ করছে—আমি যাই। নিতাই তাঁর দাদাকে নিয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। প্রীতি কী করবে বুঝতে পারছে না। ক্ষোভে দুঃখে না অপমানে চোখ তাঁর সজল হয়ে উঠছে, তাও বুঝতে পারছে না। সে দাঁড়িয়ে আছে—একা।