Ticker

6/recent/ticker-posts

মহাভারতের মহারণ্যে - প্রতিভা বসু [০৮]

amarboi
মহাভারতের মহারণ্যে
প্রতিভা বসু



পাণ্ডবদের বিষয়ে দুর্যোধন এই প্রথম মুখ খুললেন, পিতাকে বললেন, ‘হে পিতঃ! পৌরগণ নাকি আপনাকে পরিত্যাগ করে যুধিষ্ঠিরকেই রাজা করতে চাইছে? এই অশ্রদ্ধেয় বাক্য শুনে আমার অত্যন্ত মনোবেদনা হচ্ছে। শেষে কি আমরা রাজবংশে থেকে জনগণের মধ্যে হীন ও অবজ্ঞাত হয়ে থাকবো? পরপিণ্ডোপযোগী লোকেরা নরকভোগ করে। অতএব, হে রাজন! যাতে আমরা ঐ নরক থেকে মুক্ত হতে পারি, এরকম কোনো পরামর্শ করুন।’

বর্ধনশীল যুধিষ্ঠিরকে কীভাবে রোধ করা যায়, কী করলে ধৃতরাষ্ট্র জীবিত থাকতেই প্রজাবিদ্রোহ না ঘটে, সে বিষয়ে পিতা-পুত্র আপাতত রক্ষা পাবার মতো একটা সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হলেন।

যেখানে রাজত্ব নিয়ে পিতাপুত্রেই সংঘর্ষ হয়, যেখানে কুন্তী-বিদুর মিলে হয়তো বা পাণ্ডু-মাদ্রীকে হত্যা করতে পারেন, যেখানে কয়েকজন পর্বতনিবাসী যারা সত্যিই পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ কিনা এবং প্রকৃতই যুধিষ্ঠির দুর্যোধন অপেক্ষা এক বৎসরের বড়ো কিনা সেটা প্রমাণিত তথ্য নয়, সেখানে সাবধান হওয়াটাই বা নিন্দনীয় হবে কেন?

দুর্যোধন বললেন, ‘কিছুদিনের জন্য পাণ্ডবরা সপরিবারে যদি অন্যত্র কোথাও গিয়ে কাটিয়ে আসেন, তাহলে আমি বিদ্রোহীদের ধন ও সমুচিত সম্মান প্রদর্শন করে তাদের পরিতুষ্ট করবো। আপনি যদি কোনোভাবে ওদের বারণাবতে পাঠিয়ে দিতে পারেন, তবে সেই সময়ের মধ্যেই আমরা সমুদয় কার্য শেষ করে নিতে পারবো। সেখানে এই সময়টাতে খুব সুন্দর একটা মেলা হয়।’

প্রকৃতই বারণাবতে সেই সময়ে একটা উৎসব হয়। সভায় বসে সকলের মুখে বারণাবতের প্রশংসা শুনে পাণ্ডবরা সেখানে যাবার জন্য বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করলেন। প্রশংসাটা অবশ্য উদ্দেশ্যমূলকভাবেই করা হচ্ছিলো। পাণ্ডবদের আগ্রহ দেখে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ‘বেশ তো, কিছুদিন না হয় সবান্ধবে ও সপরিবারে গমন করে পরম সুখে কাটিয়ে পুনরায় হস্তিনানগরে প্রত্যাগমন করো।’ ধৃতরাষ্ট্রর এই কথার মধ্যে এমন কিছু ছিলো না যাকে ভয় দেখিয়ে পাঠানো বা জবরদস্তি বলা যেতে পারে। তদ্ব্যতীত, তিনি তাদের ‘আমোদ আহ্লাদ করে কিছুদিনের মধ্যেই ফিরে এসো’ এ কথাও বলে দিয়েছিলেন কিন্তু তারা ফিরে আসেননি। ফিরে আসার জন্যও যাননি।

বিদুর তাঁদের অজ্ঞাতবাসে পাঠাবার জন্য সব ব্যবস্থাই পূর্ব থেকে করে রেখে যে সুযোগ খুঁজছিলেন সেটা পেয়ে গেলেন। পরে এ কথা তো রটনা করতে হবে যে ভাগ দেবার ভয়ে দুর্যোধনই কোথাও জীবনের মতো সরিয়ে দিয়েছেন পাণ্ডবদের। কুরুকুলকলঙ্কী মন্দবুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্র কী করে এমন একটা অধর্মানুষ্ঠান করতে উদ্যত হলেন? মহাত্মা ভীষ্মই বা কেমন করে এরকম একটা একান্ত অশ্রদ্ধেয় বিষয় অনুমোদন করলেন? যুধিষ্ঠির ব্যতীত অন্য ভ্রাতারা এটাকে একটা আমোদপ্রমোদের ভ্রমণ বলেই মনে করলেন, কিন্তু বিদুরের ষড়যন্ত্রে ও পরামর্শে যুধিষ্ঠির জানতেন কোনটার পরে কোনটা করতে হবে এবং কোন পথে পা ফেলতে হবে। বিদুরও যাবার মুহূর্তে ম্লেচ্ছ ভাষায় সেই ষড়যন্ত্রের বিষয়টি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিলেন। যুধিষ্ঠিরও বললেন, ‘বুঝেছি।’

ইতিমধ্যে বিদুর হস্তিনাপুরবাসীদের নিকট এটা খুব ভালোভাবেই প্রচার করে দিলেন, ধার্তরাষ্ট্ররা ওদের পুড়িয়ে মারবার জন্যই ওখানে পাঠালেন। ধর্মের মুখোশ পরে বিদুর স্বীয় স্বার্থ সম্পাদনার্থে সততই অধর্মের কূপে নিমজ্জিত করে রাখলেন নিজেকে। এবং তাঁর পিতা দ্বৈপায়ন আমৃত্যু তাঁকে প্রশ্রয় দিয়ে গেলেন।

বারণাবতে যাওয়া মানেই নির্বাসনে যাওয়া এ কথাটা মহাভারত কী অর্থে ব্যবহার করেছে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। অথচ বারণাবত প্রকৃতই একটি অতি সুন্দর নগর। ভ্রমণের পক্ষে অতি উৎকৃষ্ট স্থান। দেশের লোকেদের নিকট বিদুর যদিও বারণাবতে পাঠিয়ে ধার্তরাষ্ট্ররা পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারবে বলে অনেক কুম্ভীরাশ্রু নির্গলিত করেছেন, ভিতরে যে কতো উল্লসিত হয়েছেন তার কোনো সীমা নেই। এটাই চেয়েছিলেন তিনি। যে নৌকাটি প্রস্তুত করে রেখেছিলেন সেটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তৈরি, যন্ত্রযুক্ত এবং বায়ুবেগ সহনক্ষম। সমুদ্রতরঙ্গও এই নৌকাকে সহসা মগ্ন করতে পারে না। কুন্তীসহ পুত্রদের অজ্ঞাতবাসে পাঠাবার জন্য ঋজুপথ, বক্রপথ সমস্ত পথই তিনি সাজিয়ে ফেলেছিলেন। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তিনি তাঁর মনের দর্পণে প্রতিফলিত দেখতে পেয়ে যুধিষ্ঠিরের হস্তে সেই মানচিত্রটিই ধরিয়ে দিলেন যাবার সময়ে।

পাঁচটি পর্বতনিবাসী পুত্র এবং কুন্তীকে নিয়ে বিদুর যা করছেন সেটা হয়তো দুর্যোধনের মতোই তখন অনেকের কাছেই বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিলো। ব্যাসদেবের এই ইতিহাসে তাদের কোনো নাম নেই। দ্বৈপায়ন নিজেও এদের কোনো অন্যায় দেখেও দেখেননি, শুনেও শোনেননি, কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। তিনি এড়িয়ে গেলেও অনেক মানুষের চিত্ত বিদুরের প্রচারে যে সায় দেয়নি সেটা যুদ্ধের সময়ে খুব ভালোভাবেই বোঝা গিয়েছিলো।

ভীষ্ম তখন অনাদৃত। ভালো মন্দ কোনোদিকেই আর মনোযোগ বা নিবিষ্টতা খরচ করেন না তিনি। ধৃতরাষ্ট্র একান্তভাবেই বিদুরের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন। দুর্যোধন একা কী করতে পারেন? তবে এতোদিনে দুর্যোধন আরো একটি কথা পিতার শ্রবণে প্রবিষ্ট করাতে সক্ষম হলেন যে বিদুর তাঁর পিতার অর্থবহ হয়েও প্রতিকূল ব্যবহার করছেন। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, ঐ পাঁচটি ভ্রাতা ধার্তরাষ্ট্রদের প্রতি নিষ্ঠুর হলে নিন্দে নেই, কুরুকুলের ভ্রাতা সেজে এসে কুরুকুলের শত্রু হলে নিন্দে নেই, যতোদিন দুর্যোধন না জন্মালেন ততোদিন পর্যন্ত পাণ্ডু কেন ক্ষেত্রজ পুত্র গ্রহণ করেননি তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, অতোবড়ো সাম্রাজ্যের প্রাক্তন অধিপতি কী ভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন তা নিয়ে কোনো তদন্ত নেই, রাজ্যে খবর পাঠিয়ে মৃত পাণ্ডুকে কেন রাজার মতো সমারোহ করে আনা হলো না তা নিয়ে কোনো বিকার নেই, কেন এই পুত্রগণ পিতার মৃত্যুকালে উপস্থিত হয়নি এবং কুরুরাজ্যে এসে একদিনের জন্যও পিতার নাম উচ্চারণ করেনি বা পিতৃশোকে কাতর হয়নি তা নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই, কেনই বা তাদের মাতা কুন্তী অতি নিভৃতে অতি নিঃশব্দে সেই মৃত্যু গোপন রাখলেন, মাদ্রীই বা কী ভাবে মৃত হলেন, এবং মাদ্রীর পুত্ররা মাতৃশোকে এক বিন্দুও বিচলিত নয় কেন তা নিয়েও কোনো জিজ্ঞাসা নেই, কেন শববাহকরা সে বাটীতে একবিন্দু জলস্পর্শ পর্যন্ত করলেন না তা নিয়েও কোনো বিতর্ক নেই। যা আছে তা শুধু দাবি। পাণ্ডব নামধারী পাঁচটি পার্বত্য তরুণ যা করবে তার নামই বীরত্ব। একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে অর্জুনকে সর্বাপেক্ষা বড়ো তীরন্দাজ হিশেবে গণ্য করার নামও বীরত্ব, কর্ণের নিকট অর্জুন দ্বন্দ্বযুদ্ধে হেরে যাবেন ভয়ে জন্মবৃত্তান্তের দোহাই দিয়ে কর্ণকে ঠেকিয়ে রাখার নামও বীরত্ব। আর যে মানুষটি লোভে কামে অক্ষমতায় সাধারণের অপেক্ষাও সাধারণ, তিনি মহাত্মা। সমস্ত মহাভারতে একমাত্র যিনি একবার হোক, দুবার হোক, স্বীয় স্বার্থে অনৃতভাষণের দোষে দুষ্ট, তিনিই সত্যবাদী যুধিষ্ঠির।

পাণ্ডবরা বারণাবতে গিয়ে দেখলেন প্রকৃতই একটি জনাকীর্ণ মনোরম নগর। সবাই যখন সেখানে পুরঃপ্রবেশ করলেন, তখন সেখানকার অধিবাসীরা তাঁদের যথেষ্ট সমাদরে গ্রহণ করলেন। পুরবাসীদের আদর আপ্যায়ন সম্মান ইত্যাদি সাঙ্গ হলে তাঁরা যখন তাঁদের জন্য রক্ষিত সুরম্য হর্ম্যে প্রবিষ্ট হলেন, দেখা গেলো পুরোচন অত্যুৎকৃষ্ট ভক্ষ্য পেয় আসন ও শয্যা সমুদয় রাজভোগ্য দ্রব্যও প্রস্তুত করেছে। এ সব ধৃতরাষ্ট্রের আদেশেই হয়েছে। সুব্যবস্থার কোনো ত্রুটি নেই। পরম আনন্দে, পরম বিলাসিতায়, দশ দিন তাঁরা সেই হর্ম্যেই বাস করলেন। দশ দিন পরে তাঁরা তাঁদের জন্য নির্মিত ‘শিব’ নামক গৃহে—যেটাকে জতুগৃহ বলা হয়েছে, সেখানে বাস করতে এলেন।

পুত্রগণসহ কুন্তী এবং তাঁদের দেখাশুনো করবার জন্য পুরোচন একসঙ্গে গিয়েই বারণাবতে পৌঁছেছিলেন। পাণ্ডবগণ গিয়েছিলেন বায়ুবেগগামী সদশ্বযুক্ত রথে আর পুরোচন গিয়েছিলেন দ্রুতগামী অশ্বতরযোজিত রথে। ধৃতরাষ্ট্রকে সরিয়ে দুর্যোধনের ন্যায্য অধিকার অস্বীকার করে, যুধিষ্ঠিরকে কুরুরাজ্যের ভূপতির আসনে বসাবার জন্য বিদুরের মন যতোটা একাগ্র ছিলো, তাঁর পিতা দ্বৈপায়নের মনও ততোটাই। সেই মন ছাপিয়ে যতোটুকু উদ্বৃত্ত তথ্য তিনি পরিবেশিত করেছেন তা হতে পারে জনমতের চাপে, অথবা তাঁর নীতিবোধ অন্যরকম ছিলো, অথবা তা পরবর্তীকালের বিভিন্ন রচয়িতার অবদান। সেই কারণেই, সহস্র সহস্র বৎসর অতিক্রান্ত হবার পরেও, ঐ পারিবারিক এবং সামাজিক ইতিহাস মানুষের মনকে উদ্ভ্রান্ত করে, চিন্তিত করে, উত্তেজিত করে, ক্রুদ্ধ করে এবং ব্যক্তিগত বোধ বুদ্ধি নীতি অনুযায়ী সত্য উদ্ঘাটনে প্ররোচিত করে। বিদুরের প্রতি বাৎসল্যবশতই দ্বৈপায়ন হঠাৎ হঠাৎ এসে পুত্রের অভিপ্রায় পূর্ণ করে যান। উল্লেখ না থাকলেও অনুভবে বাধা হয় না, বিদুরও প্রায়শই পিতার নিকট গিয়ে তাঁর সান্নিধ্যলাভে সমাদৃত হন। বিদুরের পুত্র যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্বৈপায়নের স্নেহ অন্যান্য পিতামহের মতোই প্রবল।

দশ দিন পরে তাঁদের জন্য নির্মিত গৃহে প্রবিষ্ট হয়েই যুধিষ্টির ভীমকে বললেন, ‘দেখ ভাই, এ গৃহ ঘৃত লাক্ষা ও বসা প্রভৃতি দাহ্য পদার্থ দিয়ে তৈরি। ওরা আমাদের পুড়িয়ে মারতে চায়।’ ভ্রাতারা কিছু অনুভব না করলেও যুধিষ্ঠির প্রায় মুখস্থের মতো বলে গেলেন সেই সব পদার্থের নাম। জতুগৃহ নামের বাড়িটি নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তা প্রায় পৃথিবীর সকল গোয়েন্দা গল্পের মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ গল্প বলা যেতে পারে। দাহ্য পদার্থ দিয়ে কে যে ঐ বাড়িটির নির্মাতা তার ঠিকানা কেউ সঠিক জানে না, যদিও বলে দেওয়া নামটা সেই হতভাগ্য দুর্যোধনের। হস্তিনাপুরে থাকাকালীন যুধিষ্ঠিরের মুখনিঃসৃত একটি বাণীও কারো শ্রুতিগোচর হয়নি। যৌবরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও তাঁর মুখে কোনো বক্তব্যই কেউ শোনেনি। যা বলবার, বলেছেন বিদুর। কিন্তু হস্তিনাপুর থেকে বেরিয়েই তিনি অন্য মানুষ।

এখানে কয়েকটি বিষয় একটু খতিয়ে দেখা যাক। প্রথম কথা, পাণ্ডবদের জন্য মাত্র দশ দিনে ঐ রকম একটি চতুঃশাল গৃহ নির্মাণ করা যেমন কঠিন, তেমনি কঠিন গৃহে শণ ও সর্জরস প্রভৃতি যাবতীয় বহ্নিযোগ্য দ্রব্য প্রদান করা, মৃত্তিকাতে প্রচুর পরিমাণে ঘৃত তৈল বসা ও লাক্ষাদি মিশিয়ে তা দিয়ে ঐ গৃহের প্রাচীর লেপন করা। তাছাড়া, এসব কাজ কখনো যাদের পুড়িয়ে মারবার হেতু করা তাদের সাক্ষাতে কেউ করে না। আর সাক্ষাতে না করলে যুধিষ্ঠির জানলেন কী করে? গন্ধে এতো কিছু আন্দাজ করা সম্ভব নয়। যা যা দিয়ে দেয়াল প্রলেপিত হয়েছে, তার প্রত্যেকটির নাম জানাও সম্ভব নয়। তদুপরি, এতো কিছু জেনে সে বাড়িতে যাওয়াও সম্ভব নয়। হস্তিনাপুর থেকে বেরিয়ে যদিও তাঁর কণ্ঠস্বরে যথেষ্ট জোর বেড়েছে, কিন্তু বুদ্ধিটা ততো খোলেনি। এখানে আসবার মুহূর্তে সে সব কথা পিতার ম্লেচ্ছ ভাষার সাহায্যে শুনেই জেনেছেন। এবং এটা একদিনের শ্রাব্য কথা নয়, অনেক দিনেরই শিক্ষা। সেই শিক্ষাটাই বাড়ি থেকে বেরোবার পূর্ব মুহূর্তে ঝালিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।

ভীম এদিক ওদিক তাকিয়ে গন্ধ নেবার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু কিছু বুঝতে পারলেন না। পরে বললেন, ‘যদি মনে করেন এখানে অগ্নিভয় আছে, তবে চলুন আমরা পূর্ব বাসস্থানেই ফিরে যাই।’ যুধিষ্ঠির রাজি হলেন না। কেন হলেন না? তাঁরা না এলে পুরোচন কি তাঁদের জোর করে নিয়ে যেতে পারতো? এতো ভয় কেন? তাঁরা রাজা, তাঁদের তা অনিরাপদে থাকার কথা নয়। দেশবাসীরা সবাই তাঁদের রাজসম্মানেই গ্রহণ করেছে, শ্রদ্ধা করেছে, চাইলে তাঁরা সকলেই সসম্মানে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজেদের কৃতার্থ মনে করতো। তদ্ব্যতীত, ধৃতরাষ্ট্র তো তাঁদের সেখানে আজীবন থাকার কথা বলেননি, জোর করেও পাঠাননি। তাঁরা যেতে চাইলে বলেছেন, কয়েকদিন আমোদ আহ্লাদ করে ফিরে এসো। কেন তাঁরা প্রত্যাবৃত্ত হলেন না? যুধিষ্ঠির এক অবিশ্বাস্য যুক্তি দিয়ে বললেন, ‘শোনো, আমরা একথা বুঝতে পেরেছি জানলে আমাদের পুরোচন বলপ্রয়োগ করে দগ্ধ করবে।’

যদি পুরোচন তাঁদের বলপ্রয়োগেই দগ্ধ করতে সক্ষম, তবে কষ্ট করে এতো বড়ো বাড়িটা তৈরি করবার কী প্রয়োজন ছিলো? তাঁরা তো এখানে থাকতে আসেননি, এসেছেন বেড়াতে। দাহ্য পদার্থ দিয়ে গৃহ তৈরি না করলেও কি কোনো গৃহ অগ্নিদগ্ধ হয় না? অগ্নি সর্বভুক। সুযুপ্ত অবস্থায় রাজা মহারাজাই হোন, বা ফকির ভিখারিই হোন, তার নিকট সকলেই সমান ভক্ষ্য। ইচ্ছে করলে সেটা তো হস্তিনাপুরেও হতে পারতো। তবু যদি ধরা যায় স্বশাসিত নগরে এমন অপকর্ম করায় ধৃতরাষ্ট্র বা দুর্যোধনের আপত্তি ছিলো, দুর্নামের ভয় ছিলো, তথাপি এ প্রশ্ন থেকেই যায়, যাঁরা মাত্র কয়েকদিনের জন্যই বেড়াতে এসেছেন, তাঁরা নিজেদের রাজত্ব ছেড়ে সম্পূর্ণ একটি বৎসর কেন সেখানে অবস্থান করলেন? আর সেই গৃহে পা দেওয়া মাত্রই কেন বিদুর তৎক্ষণাৎ একটি খনক পাঠিয়ে দিলেন? এবং সেই খনক যেমন তেমন খনক নয়। একজন অতিশয় কৃতবিদ্য প্রযুক্তিবিদ। অতো দূরে বসে বিদুর কী করে তাদের অনুকোটি চৌষট্টি খবর রেখেছেন, যদি না চর-অনুচরের যাতায়াত অব্যাহত থাকে?

যুধিষ্ঠির ভীমকে এ কথাও বললেন, ‘দ্যাখো, শত্রু নির্মিত এই জতুগৃহ দগ্ধ হলে পর পিতামহ ভীষ্ম ও অন্যান্য কুরুবংশীয় মহাত্মারা অতিশয় ক্রোধান্বিত হবেন। বলবেন, ‘‘কে এই অধার্মিক কর্ম করালো’’?’ এই বাক্য ক’টি যুধিষ্ঠির এমন নিশ্চিত ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলেন যা থেকে খুব স্পষ্ট ভাবেই বোঝা যায় তিনি জানতেন পুড়ে যাঁরা মরবেন তাঁরা আর যেই হোন, কুন্তীর পঞ্চ পুত্র নন। যাঁরা অগ্নি প্রদানে সেই গৃহ প্রজ্বলিত করবেন, তাঁরাও ধার্তরাষ্ট্রদের কেউ নন। যদি সেই ভয়ই তাঁর থাকতো তবে জেনেশুনে কী করে একথা বললেন, ‘জতুগৃহ দগ্ধ হলে পিতামহ ভীষ্ম ও অন্যান্য কুরুবংশীয় মহাত্মারা অতিশয় ক্রোধান্বিত হবেন।’ তাঁরা যদি দগ্ধই হন, তবে কে কী বললো আর না বললো কী এসে যায় তাতে? তদ্ব্যতীত, তাঁদের দগ্ধ করবার জন্যই যদি দাহ্য পদার্থ দিয়ে বাড়িটি তৈরি হয়, পুরোচনের জন্য যে বাড়ি সে বাড়ি তো অমন দাহ্য পদার্থ দিয়ে তৈরি করবার কোনো প্রশ্ন ছিলো না। যিনি তাদের পোড়াবেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনিও কি নিজেকে পুড়িয়ে মারবেন? সহমরণ?

পিতামহ কৃষ্ণদ্বৈপায়নের রচনার চাতুর্য, পিতা বিদুরের কাপট্য আর মাতা কুন্তীর হৃদয়হীনতা, এই তিনটি পাথেয় নিয়েই যুধিষ্ঠির চালিত হচ্ছিলেন কুরুরাজ্য দখলের জন্য। আর এঁদের সকলের দুষ্কর্মের বোঝা বহন করছিলেন হতভাগ্য দুর্যোধন। পুড়ে মরবার জন্যই কি সম্পূর্ণ এক বৎসর ভ্রাতাগণ আর তাদের মাতাকে অপেক্ষা করতে হলো সেখানে? এটা কি সম্ভব? যে করেই হোক নিশ্চয়ই তাঁরা বেরিয়ে পড়তেন সে বাড়ি থেকে। একটা পাতালপথ তৈরি হওয়া তো সহজ ঘটনা নয়, দু-একদিনের ব্যাপারও নয়, দু-একজন মানুষের কর্মও নয়। প্রযুক্তিবিদ্যার উৎকৃষ্ট নির্দশন এই সুড়ঙ্গ পথ তৈরি হতে সময় লাগলো সম্পূর্ণ একটি বৎসর। এই এক বছর কেন পুরোচন নিশ্চেষ্ট অবস্থায় বসে রইলেন? দাহ্য পদার্থে তৈরি তাঁর বাড়ির ওপর এতোদিন ধরে কী কাজকর্ম হচ্ছে সেটা জানবারও কৌতূহল কি তাঁর হলো না? তাছাড়া, যে মানুষ এতোগুলো বিশেষ লোককে পুড়িয়ে মারবার মতো একটা নৃশংস, গূঢ় অভিসন্ধি নিয়ে একটা বিশেষ হর্ম্য তৈরি করেছেন, তিনি নিশ্চয়ই সদাসতর্ক থাকবেন, অশান্ত থাকবেন, এবং অনুক্ষণই উদ্দেশ্য সাধনের সুযোগ খুঁজে বেড়াবেন। উপরন্তু, দশদিনে তৈরি বাড়ির ওপর দিয়ে এতোগুলো ঋতুই বা বয়ে যেতে দেবেন কেন? দাহ্য পদার্থ তো অনন্তকাল ধরে প্রলেপিত থাকতে পারে না? কখনো তা গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে দগ্ধ হবে, কখনো বর্ষার অবিরল বারিপাতে ধৌত হবে। পাণ্ডবরা না হয় পালাবার রাস্তা তৈরি না হলে লুকিয়ে বেরোতে পারছিলেন না। কিন্তু পুরোচনের তো সে ভাবনা নেই, সে অযথা সময় নষ্ট করবে কেন? রাত কি কখনো গভীর হয়নি? পাণ্ডবরা কি ক্লান্ত দেহে নিদ্রাচ্ছন্ন হননি কখনো? অাসলে এ বাড়ি আদপেই পুরোচনের তৈরি নয়। অন্তত দাহ্য পদার্থের ব্যবহার তিনি কখনোই করেননি।

যেদিন পাতালপথ সম্পূর্ণ হলো, এবং যুধিষ্ঠির মনে করলেন সময় উপস্থিত হয়েছে, সেদিন চারিদিক নিঃঝুম হলে তিনি বললেন, ‘এবার আগুন দাও। প্রথমে পুরোচনের গৃহ ভস্ম করো, তারপর আরো ছয়জনকে এখানে রেখে পুড়িয়ে আমরা অলক্ষিতে পলায়ন করবো।’

ছয়জন সেখানে কারা থাকবেন? দয়ার অবতার মহাত্মা যুধিষ্ঠির আর যুধিষ্ঠিরের দয়ার্দ্রচিত্ত মাতা কুন্তী সে ব্যবস্থাও ঠিক করে রেখেছেন। কুন্তী চালাকি করে সেদিন সন্ধ্যায় কয়েকজন ব্রাহ্মণব্রাহ্মণীকে নিমন্ত্রণ খাওয়ালেন। তারা চলে যাবার পর একজন ক্ষুধার্ত নিষাদ মাতাকে তার পাঁচপুত্রসহ এতো অধিক পরিমাণে পান ভোজন করালেন যে তারা হতজ্ঞান ও মৃতকল্প হয়ে সেখানে পড়ে রইলো। জ্যেষ্ঠের আদেশে ভীম প্রথমেই পুরোচনের গৃহে (এখানেই প্রমাণিত হলো পুরোচনের গৃহ আলাদা ছিলো এবং দাহ্যপদার্থে প্রলেপিত ছিলো) আগুন দিলেন, পরে জতুগৃহের চারিদিকে অগ্নিপ্রদান করে যখন দেখলেন অগ্নি সর্বত্র প্রজ্বলিত হয়েছে, তখন মাতা ও ভ্রাতৃগণসহ সেই পাতাল পথে নিষ্ক্রান্ত হলেন।

ভেবে দেখুন কতদূর লোভী হলে, পাপিষ্ঠ হলে মানুষ এভাবে একটি নির্দোষ দুঃখী রমণীকে তার পাঁচ পাঁচটি পুত্রসহ পুড়িয়ে মারতে পারে। অন্যের রাজ্য কেড়ে নেবার লোভে যদি যুধিষ্ঠির এই ভয়ঙ্কর কর্মে প্রবৃত্ত হন, তবে দুর্যোধন তাঁর পিতাকে উচ্ছিন্ন করে, তাঁকে বঞ্চিত করে যারা সেই সিংহাসনের দখল চায়, তাদের প্রতিবন্ধক হলে তাঁর অপরাধটা কোথায়? তিনি নিশ্চয়ই তাঁর পিতাকে রক্ষা করবেন, নিজের স্বার্থ দেখবেন। সেটাই তো তাঁর ধর্ম, তাঁর কর্তব্য। যদিও দুর্যোধন তাঁর সারাজীবনে কখনো ততোটা নীচে নামবার কথা ভাবেননি, যতোটা নীচে পাণ্ডব নামধারী যুবক ক’টিকে বিদুর এবং দ্বৈপায়ন নামাতে পেরেছেন। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড সমাপ্ত করতে কুন্তীর চোখের পাতাটি নড়লো না। পাঁচটি পুত্রেরও একবিন্দু বিবেক দংশন হলো না।

আর একদিকে হুতাশনের অগ্নিতাপ যখন প্রবল আকার ধারণ করলো, বিদুরের কৃপায় সমস্ত পুরবাসীগণ অতিশয় দুঃখিত হয়ে বলতে লাগলেন, ‘দ্যাখো, দুরাত্মা পুরোচন পাণ্ডবদ্বেষী কুরুকলঙ্ক পাপাত্মা দুর্যোধনের আদেশানুসারে, নিরপরাধ সুবিশ্বস্ত সমাতৃক পাণ্ডবগণকে দগ্ধ করবার জন্য যে গৃহ নির্মাণ করেছিলো, এখন তাতে অগ্নিপ্রদান করে স্বীয় মনস্কামনা সিদ্ধ করলো। ধর্মের কি অনির্বচনীয় মহিমা! দুরাত্মা নিজেও এই প্রদীপ্ত হুতাশনে দগ্ধ হলো। দুরাত্মা ধৃতরাষ্ট্রকে ধিক্, কী দুর্বুদ্ধি! ঐ দুরাত্মা পরমাত্মীয় ভ্রাতুষ্পুত্রগণকে শত্রুর মতো অনায়াসে দগ্ধ করলো।’ যে কথা যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের পূর্বে বলেছিলেন ঠিক তাই হলো। কিন্তু এরা এটা জানলো কী করে যে ধৃতরাষ্ট্র এদের পুড়িয়ে মারবার জন্যই এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন? এটা তো এই দেশবাসীদের জানবার বা ভাববার প্রশ্নই নেই। বিদুরের প্রচারমহিমা এখানেও কার্যকরী হলো।

মাতৃসমবেত পাণ্ডবেরা যখন পাতাল পথ দিয়ে দ্রুতবেগে চলতে লাগলেন, মহাভারতের বর্ণনা অনুসারে ‘ভীম ব্যতীত সকলেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তখন ভীম মাতাকে স্কন্ধদেশে, নকুল ও সহদেবকে কোলে নিলেন এবং যুধিষ্ঠির ও অর্জুনের দুই হাত ধরে বায়ুবেগে চলতে লাগলেন। ভীমের বক্ষের আঘাতে বনরাজি ও তরুসকল ভগ্ন, ও পদাঘাতে ধরাতল বিদীর্ণ হতে লাগলো।’ শুধু তাই নয় ‘গমনকালে তার ঊরুবেগে বনস্থ বৃক্ষ সকল’ শাখা প্রশাখার সঙ্গে থরথর করে কাঁপতে থাকলো। তার ‘জঙ্ঘাপবনে পার্শ্বস্থ বৃক্ষ ও লতা সব ভূতলশায়ী’ হলো। তা হলেই ভেবে দেখুন, দুর্যোধনের উপর যখন ভীম খেলাচ্ছলে আক্রমণ করতেন, তখন সেই আক্রমণ কী ভয়ঙ্কর হতো! দিনের পর দিন তাঁরা কী কষ্ট সহ্য করেছেন! কিন্তু সেটা নিয়ে কোনো কথা নেই, ব্যথা নেই, শাসন নেই, নিন্দে নেই। অথচ অতিষ্ঠ হয়ে দুর্যোধনরা যখন তাঁকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে, লতা দিয়ে বেঁধে ফেলে এলেন জলের ধারে, তা নিয়ে দুর্যোধনের প্রতি অকথ্য নিন্দায়, বিদুরের অপপ্রচারে, পুরবাসীগণ মুখর হয়ে উঠলো। আসল কারণটা কেউ দেখলো না, ভাবতে লাগলো, সত্যই রাজত্বের ভাগ না দেবার জন্য বিষ খাইয়েছে দুর্যোধন। ভীমকে মেরে সে উদ্দেশ্য সাধিত হওয়া যে নেহাৎ অসম্ভব সেটা দুর্যোধন নিশ্চয়ই বুঝতেন।

পাতালপথ শেষ হলে যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের, এবং মাতাকে নিয়ে অন্য একটা জায়গায় এসে আকাশের তলায় দাঁড়াবেন। নিকটেই নদী। পথ প্রদর্শক সেখানেই অপেক্ষা করছিলো। সকলকে নিয়ে নদীতীরে এলেন। সেখানে জলযান অপেক্ষাই করছিলো তাঁদের জন্য। আরোহণ করলে চালক বললো, ‘মহাত্মা বিদুর আপনাদের তাঁর আলিঙ্গন জানিয়ে বলে দিয়েছেন যে আপনারা অবশ্যই কর্ণ দুর্যোধন ও শকুনিকে সংগ্রামে পরাজিত করবেন। এই তরঙ্গসহা সুগামিনী তরণীতে আপনারা নিঃসন্দেহে সমস্ত দেশ অতিক্রম করতে পারবেন।’ এখানে সংগ্রামের কথা উঠলো কেন, যদি না গোপনে গোপনে অন্য কোনো রাজার সঙ্গে ষড়যন্ত্র না করে থাকেন? তা ব্যতীত, তাঁরা যে পুড়ে মরেননি, সে কথাই বা বিদুর জানলেন কী করে সমস্ত ঘটনাটা যদি পূর্বপরিকল্পিত না থাকতো?

নৌকোয় উঠলেন তাঁরা, গঙ্গা পার হয়ে অপরতীরে অবতরণ করলেন। অবতরণ করে এদিক ওদিক তাকালেন না, নির্দিষ্ট ভাবে দক্ষিণ দিকে যেতে লাগলেন। কী ভাবে কোন পথে গমন করলে কী হবে, কুন্তী আর যুধিষ্ঠিরের জানাই ছিলো। বনপথে কিছুদূর যেতেই অপেক্ষমান ব্যাসদেবের সাক্ষাৎ মিললো। তিনি বললেন, ‘আমি সব জানি, পরিণামে তোমরা সুখী হবে। ধার্তরাষ্ট্রগণ ও তোমরা আমার পক্ষে উভয়েই সমান, কিন্তু আমি ধৃতরাষ্ট্রের সন্তানগণ অপেক্ষা তোমাদের অধিক ভালোবাসি। অধিক স্নেহ করি।’ যে ব্যাসদেবকে আমরা নিষ্কাম নির্মোহ ব্রহ্মচারী ঋষি বলে জানি তিনি নিজ মুখেই এ কথা বলছেন। তারপর বললেন, ‘আমি স্নেহবশে তোমাদের হিতসাধনে উদ্যত।’ এই বলে তাঁদের নিয়ে একচক্রা নগরীতে এলেন, এসে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘মাতৃ-ভ্রাতৃ সমভিব্যাহারে একমাস এখানে পরম সুখে অবস্থান করো। মাস পূর্ণ হলে আমি আবার আসবো।’

এটাই হলো যুদ্ধ করে ধৃতরাষ্ট্রকে সিংহাসনচ্যুত করবার এবং যুধিষ্ঠিরকে সেই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করবার প্রধান পদক্ষেপ। এখন যে যার মনে ভাবতে থাকুন, এই জতুগৃহ নামে গোয়েন্দা গল্পটির আসল ষড়যন্ত্রীটি কে? পূর্বাপর পরিকল্পনাই বা কার? অত দাহ্য পদার্থ দিয়ে বাড়িটি বানিয়ে, পাণ্ডবদের পুড়িয়ে না মেরে, কেনই বা সম্পূর্ণ একটি বৎসর পুরোচন রাতের পর রাত কেবল ঘুমিয়েই কাটালো? অার যিনি মহাত্মা, যিনি দয়ার অবতার, তিনি রাজ্যের লোভে কী সুন্দর আগুন জ্বালিয়ে মাতাসহ পাঁচটি পুত্রকে দগ্ধ করে, সেবক পুরোচনকে পুড়িয়ে, দিব্যি গিয়ে পিতামহ দ্বৈপায়নের সঙ্গে মিলিত হলেন। আর দুর্যোধন কিছু না জেনে না বুঝে ওদের পঞ্চভ্রাতা ও মাতার সব পাপের বোঝা বহন করে পাপাত্মা হলেন। স্বীয় পিতা পর্যন্ত জানলেন এই কীর্তি তাঁর পুত্রের। পিতামহ ভীষ্ম দুঃখে পরিপূর্ণ হলেন। লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারলেন না। নগরবাসীরা ছি ছি করতে লাগলো। ধৃতরাষ্ট্রকেই দোষী সাব্যস্ত করা হলো, যেহেতু তিনি অতিশয় পুত্রবৎসল, নচেৎ ঐ দুরাত্মা পুত্রের কথা শুনে এই ভয়ঙ্কর কলঙ্কিত ও নিষ্ঠুর কার্যে কী করে সম্মতি জানালেন?

আর এই রটনার যিনি নায়ক, যিনি প্রত্যেকের মনে কুরুদের এই সব অধার্মিক অধম অসাধু কর্মের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সফল হলেন, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্যোধন সব জেনে-বুঝেও কোনো প্রতিবাদ করতে পারলেন না। বিদুরের কূটনৈতিক চাল এবং অনৃতভাষণের ক্ষমতার কাছে তাঁকে পরাজিত হতেই হলো, কেননা এ বিদ্যায় একেবারেই তিনি পারদর্শী নন। বিদুরের তুলনায় তিনি নেহাৎ শিশু।

একমাস পূর্ণ হলে দ্বৈপায়ন পুনরায় একচক্রা নগরীতে এলেন। তিনি তাদের এবার পাঞ্চাল নগরীতে যেতে বললেন। তারপর সেখান থেকে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে দৌপদীর স্বয়ংবর সভায় যাবার নির্দেশ দিলেন। বিদুর দ্বৈপায়নকে এটা বোঝাতে পেরেছিলেন যে ধৃতরাষ্ট্র যতোদিন বেঁচে আছেন ততোদিন সম্পূর্ণভাবে সমস্ত সাম্রাজ্য দখল করা সম্ভাবনার পরপারে। সুতরাং যে ভূপতি সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী এবং পরিচিত, অর্জুনের বীরত্ব সম্পর্কে অবহিত, ঠিক তাঁকেই ভেবে বার করেছেন। ইনি যদি পাণ্ডবদের সহায় হন, তাহলে কুরুবংশ ধ্বংস করা অনেকটা সহজ হয়ে আসবে। বিদুর এবং দ্বৈপায়ন সেই কর্মেই প্রবৃত্ত হয়ে এক পা দুই পা করে যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হলেন।

সাধারণভাবে এটাই সত্য যে বিদুর যখন দুই পক্ষেরই কেউ নন, তাঁর নিকট কুরুরাও যা পাণ্ডবরাও তাই, অতএব তিনি তৃতীয়পক্ষ। এবং তৃতীয় পক্ষের নিরপেক্ষ হওয়াই স্বাভাবিক, পক্ষপাতদুষ্ট নয়। সুতরাং পাণ্ডবরাই রাজা হোন, বা কুরুরাই রাজা হোন, তাতে তাঁর নিশ্চয়ই কিছু যায় আসে না। বরং ধৃতরাষ্ট্রের রাজবাটীতে তাঁর সম্মান অনাহত। স্বয়ং রাজা তো তাঁর হস্তধারণ করেই হাঁটছেন, তাঁর অদর্শনে রাজা অন্ধকার চোখে আরো অন্ধকার দেখছেন। অথচ পাণ্ডবদের জন্য বিদুরের কীসের এতো মাথা ব্যথা সেটাই দুর্যোধন বুঝে উঠতে পারেন না। কর্ণও তাঁর বন্ধুর মতো একই কথা ভেবে অবাক হন। বিদুরের যে পাণ্ডবদের প্রতি একটা আসক্তি এবং উদগ্র পক্ষপাত আছে সেটা এতোই প্রত্যক্ষ যে কারো চোখেই না পড়ার মতো নয়। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হলেও নির্বোধ তো নন। সমস্তক্ষণই তো বিদুর তাঁর কাছে পাণ্ডবদের স্তুতি গাইছেন, আর দুর্যোধনের মস্তকচর্বণ করছেন। তা নিয়ে কখনো কি তাঁর মনে কোনো বিকার হয় না? মনে হয় না, পাণ্ডবদের নিয়ে বিদুর এতো বাড়াবাড়ি করছেন কেন? কতোটুকু চেনেন তাঁদের। দেখলেন তো এই প্রথম। বিদুরের প্রতি ধৃতরাষ্ট্রের এই অদ্ভুত নির্ভরতা, আপাতভাবে যার কোনো যুক্তি নেই। ভীষ্ম এখন সর্বত্রই অনুপস্থিত। ধৃতরাষ্ট্র তাঁর সঙ্গে কোনো পরামর্শই করেন না। তিনিও অযাচিতভাবে দেন না। এই রাজন্যবর্গের মধ্যে পিতামহ ভীষ্ম আর কর্ণই শুদ্ধ আর্য। সম্ভবত সে জন্যই তাঁরা বর্জিত, দ্বৈপায়ন দ্বারা উপেক্ষিত।

চলবে...


বাকি পর্বগুলো পড়ুন এই লিঙ্কেঃ https://www.amarboi.com/search/label/mahabharatera-maharanye