Ticker

6/recent/ticker-posts

একজন জলদাসীর গল্প - হরিশংকর জলদাস


একজন জলদাসীর গল্প - হরিশংকর জলদাস

আপনার কি জগৎহরির কথা মনে আছে? ওই যে জগৎহরি জলদাস। মনে পড়ছে না? আহা, ঐ যে_একাত্তরের অক্টোবরে মুক্তিযোদ্ধাদের খানসেনার ঘাঁটিতে পৌঁছে দিতে গিয়ে মারা পড়ল যে জগৎহরি। আচ্ছা, আচ্ছা, মনে পড়েছে তাহলে? ঠিক বলেছেন_গভীর রাতে, যে-রাতে আকাশে দেরিতে চাঁদ উঠেছিল, কমান্ডার সেলিম খোন্দকার জগৎহরির বাঁশের দরজায় টুকটুক শব্দ তুলে চাপাস্বরে ডেকেছিলেন, 'জগৎবাবু, ও জগৎহরিবাবু, জেগে আছো নাকি?'
জগৎহরি বিড়ালপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলে কমান্ডার সেলিম আবার বলেছিলেন, 'একবার যে আমাদের সঙ্গে যেতে হয় হরিবাবু। খানসেনাদের বড় বাড় বেড়ে গেছে। ওদের শিং গজিয়েছে। শিংগুলো যে ভেঙ্গে দিয়ে আসতে হয়। তোমার পথ দিয়েই যেতে হবে, জলপথ দিয়ে। কর্ণফুলীর ওইপাড়ে কয়লার ডিপুতে আসত্মানা গেড়েছে খানকির পোরা।' খোন্দকারের মুখ আলগা। সেই আলগামুখে প্রায় গর্জন করেই কথাগুলো বলে গিয়েছিলেন কমান্ডার।

জগৎহরি কী করেছে তখন_জানতে চাইছেন? তখন জগৎহরি মুখে তর্জনি চাপা দিয়ে কমান্ডারের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে চুপিসারে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। হাফহাতা কালো গেঞ্জিটা মাথায় গলিয়ে দিয়ে গামছাটা কোমরে জড়িয়ে অন্ধকার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সরলাবালা বলে উঠেছিল, 'কই যাও? এত রাইতে কই যাও তুমি?'
'কোনো মিক্কে নো_। 
ইক্কিনি হাঁইট্টাম যাইর রাসত্মাত্।' আমতা-আমতা করে বলেছিল জগৎহরি।
'এইটা হাঁডনর সময় না। বাইরে খানসেনাদের হাঙ্গামা। বিপদ চাইরদিকে চোগ পাগাই বই রইছে। এই সময় তুঁই কোনোয়ানে নো যাইও'।
'বাধা নো দিও। এ_ই যাইয়ম আর আইস্যম।' সত্য লুকানোর স্বর জগৎহরির কণ্ঠে।
'অাঁই জানি তুঁই কোনানে যাইতাছ। অাঁই পোয়াতি। ঘরত্ কেউ নাই। তোঁয়ার কিছু হইলে অাঁরে চাওইন্যা কেউ নাই। পথের ভিখারি হওন পড়িবো। অাঁর লগে লগে তোঁয়ার সনত্মানও থালা লই অলিতে গলিতে ঘুইরবো।' ম্রিয়মান কণ্ঠ সরলাবালার।
বউয়ের কথা শুনে জগৎহরি থমকে যায়। বুকটা একটু দুরম্ন দুরম্ন করে ওঠে তার। ঢোক গিলে বলে, 'এইবার শেষবার। কমান্ডার সাব বার বার অনুরোধ গরের। কুত্তার বাইচ্চা খানসেনা অলে দেশখান ছারখার গরি ফেলার। অাঁরে এইবারর মতো যাইতো দও। সামনে আর কোনোদিন যাইতাম নো। অাঁই ত্বরাত্বরি ফিরি আইস্যম, কথা দিলাম।' সরলার হাতের মুঠি থেকে লুঙ্গির কোণাটা অনেক কষ্টে ছাড়িয়ে নিয়ে সে-রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিল জগৎহরি।

তারপর তো জানেন_জগৎহরি সে-রাতে আর ফিরে আসেনি। শুধু সেরাতে কেন_ সে রাতের পর অনেকদিন অনেক রাতের পরও জগৎহরি আর ফিরে আসেনি সরলাবালার কাছে।
ডিসেম্বরে যুদ্ধ শেষ হলে সবাই জেনেছে_ সেরাতে নদীকূলের খানসেনাদের আক্রমণ করতে গিয়ে গোলার আঘাতে জগৎহরির নৌকাটি ডুবে গিয়েছিল কর্ণফুলীতে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন শুধু বেঁচেছিল সেরাতে। সে ফজর আলী। তার বাম হাত উড়ে গিয়েছিল। বুদ্ধি করে ফজর আলী শরীরটা জলে ভাসিয়ে রেখেছিল। পরদিন সকালে ডাঙ্গাচরের শেখ মোহাম্মদ নদীকূলে প্রাতঃকৃত্য সারতে এসে ফজর আলীকে খুঁজে পেয়েছিল। সেই ফজর আলীই বলেছিল_সে ছাড়া ওইদিন আর কেউ বাঁচেনি। প্রথম গুলিটা, সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে, প্রথমে এসে লেগেছিল জগৎহরির বাম চোয়ালে। নিমিষেই বাঁ কান চোখ চোয়াল উড়ে গিয়েছিল তার। হাল ধরে বসেছিল সে। গুলি লাগতেই ঝুপ করে নদীতে পড়ে গিয়েছিল। তারপর জগৎহরির নৌকাটি চক্রাকারের ঘুরতে শুরম্ন করেছিল। ঠিক ওই সময়েই চাঁদটা পুবাকাশে মাথা তুলেছিল। তারপর যা হবার তা-ই হয়েছিল।
অনেকদিন পর, যুদ্ধ শেষের অনেক মাস পর, তখন ফজর আলী হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে, খুঁজতে খুঁজতে সরলাবালা ফজর আলীর গ্রাম বৈলছড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছিল। ঝিম মেরে ফজর আলীর সব কথা শুনেছিল সরলা। ফজর আলীর কথা শেষ হলে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, 'গুলি লাগার পর পোলার বাপ কি কচ্ছিল? নদীত্ পড়ি গেছিল?'
ফজর আলী নীরবে উপরে-নিচে মাথা নেড়েছিল।
'তাইলে অাঁর সোয়ামি মরে নাই। গুলি লাগার পর আন্নে যদি বাঁচি থাইকত্তে পারেন, তাইলে অাঁর সোয়ামিও বাঁচি আছে। তাইনে বাঁচি আছে। পোলার বাপ বাঁচি আছে।' শেষের কথাগুলো বিড়বিড় করেই বলেছিল সরলাবালা। বলতে বলতে উঠে পড়েছিল ফজর আলীর দাওয়া থেকে।

যুদ্ধ শেষ হয়েছে আজ চৌত্রিশ বছর। জানতে চাইছেন_জগৎহরির বউ কেমন আছে? তার সনত্মানের কথাও আপনার মনে আছে দেখছি। জগৎহরির ছেলের নাম নরহরি। নরহরি তো এখন পাক্কা মাছমারা জলদাস। বাপের বড়শি বাওয়ার বিদ্যেটা সে পুরোদমে রপ্ত করে নিয়েছে। নৌকাও আছে তার একটি। বাঁশবাড়িয়া থেকে বিয়ে করেছে সে। শ্বশুরবাড়ি থেকে নরহরি একটা একগাছি লাম্বুর-হাইট্টা নৌকা যৌতুক পেয়েছে। সেটা দিয়েই বড়শি বায় সে। জেলেরা বলে _ বড়শি মারা। মাইজপাড়ার আর দু'জনকে সঙ্গে নিয়ে কর্ণফুলী ছাড়িয়ে ও-ই বঙ্গোপসাগরে বড়শি মারতে যায় নরহরি। বাপের মতোই নৌকার পাছায় হাল ধরে বসে সে। তুফান আর মঙ্গল দাঁড় টানে। কূল অাঁধার হয়ে এলে সাগরের জলে বড়শি ছিটায় সে। কত মাছ মারে? কী কী মাছ মারে? সব সময় বেশি মাছ ধরা পড়ে না। তবে মাঝে মধ্যে ঘোঁওড়া, সুন্দরী, কাঁইলা, ছোট ছোট হাঙ্গরে নরহরির নৌকা ভরে ওঠে। নরহরির ঘরে এক মেয়ে আর এক ছেলে। ছেলেটির বয়স চার-পাঁচ হবে বোধহয়। মেয়েটি বড়, তার নাম জানি না। তবে ছেলেটিকে পাড়ার লোকেরা লেন্ডাইয়া ডাকে। প্যান্ট বা কাপড়ের টুকরা কিছুই পরতে চায় না সে। উলঙ্গ থাকতে পারলেই তার আনন্দ। মা অনেক চেষ্টা করেও তার কোমরে কোন কাপড় জড়াতে পারে না। পাড়াপড়শির কাছে তাই সে লেন্ডাইয়া। মজার কথা কী জানেন? ওই লেন্ডাইয়া সব সময় সরলাবালার গা ঘেঁষে ঘেঁষেই থাকে। মুহূর্তের জন্যও কাছ-ছাড়া হয় না।

সরলাবালার বর্তমান অবস্থা জানার আগ্রহ দেখছি আপনার প্রবল। আপনি এখনই যান মাঝিরঘাটে সরলাবালার সাক্ষাত পাবেন। কী করছে সে ওখানে? কী করছে শুনবেন? তাহলে শুনুন।
ফজর আলীর বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর সরলাবালার মাথা একটু একটু আউলা-ঝাউলা হতে শুরম্ন করে। যেদিন মন লাগে দু'মুঠো রাঁধে, যেদিন মন চায় না চুলার পাশেও যায় না। ছেলেটি কাঁদে_আকুল হয়ে কাঁদে নরহরি। সরলা ধুপ ধুপ করে নরহরির পিঠে কিল মারে। কিলের চোটে ছোট্ট নরহরি চুপ মেরে যায়। খিদে চাগিয়ে উঠলে আবার কাঁদতে শুরম্ন করে। পাশের বাড়ির রামকালির মা থালাভরে ভাত-তরকারি নিয়ে আসে, সরলাবালার দিকে এগিয়ে দেয়। বলে, 'পোয়ারে নো মাইয্যো। খিদা পাইয়ে। ভাত খাবাও, তুঁইও খাও।'
সরলা রামকালির মায়ের দিকে তাকায়, মুখে কিছু বলে না। তার দু'চোখ জলে টলমল। দলা পাকিয়ে পাকিয়ে ছেলের মুখে ভাত তুলে দেয় সরলাবালা। নরহরির খাওয়া শেষ হলে নিজে খায়। ছেলে ঘুমিয়ে পড়ে। সরলাবালা খা খা রোদ মাথায় নিয়ে পা বাড়ায়। কোথায় যায়? যায় মাঝিরঘাটে। উত্তর পাশে মাইজপাড়া, দক্ষিণে নদী_ কুলকুলে কর্ণফুলী। তাদের মাঝখানে স্ট্রান্ডরোড। সেই স্ট্রান্ডরোড পেরম্নলেই নুন সাফ করার কারখানা। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা যাঁতাকলে নুন সাফ করছে কুলি-কামিনরা। তো সেই নুন-সাফাইয়ের কারখানার মাঝখান দিয়ে একটা রাসত্মা নদীর দিকে নেমে গেছে। নদীর কিনারায়, যেখান থেকে কাদা শুরম্ন হয়েছে, সেখানেই তক্তা দিয়ে ঘাট বানিয়েছে মাঝিরা। ওই ঘাট দিয়ে অপরিষ্কার নুন যেমন বড় বড় নৌকা থেকে খালাস হয়, তেমনি ওই ধরনের পালতোলা বড় বড় নৌকাতেই বরিশাল, খুলনা, ঢাকাতে পাঠাবার জন্য সাফ করা নুন ভরা হয়। ওই ঘাটে, বার বার ওই ঘাট বলছি কেন, বলতে ভুলে গেছি_ওটিই মাঝির ঘাট। আমার কথা শুনে আপনার মনে হচ্ছে _মাঝিরঘাট শুধু বুঝি নুনেরই ঘাট। আসলে কিন্তু তা না। মাঝিরঘাট থেকেই মাইজপাড়া, সাহেবপাড়া, পার্বতীফকির পাড়ার জলদাসরা নৌকা ভাসায়_ওই নদীতে, দূর সমুদ্রে। কালার পুল, চরপাথরঘাটা, ডাঙ্গারচর, লাম্বুরহাট থেকে আসা যাত্রী-নৌকাগুলেও ভিড়ে এই ঘাটে। নদীজলে চট্টগ্রাম শহরে ঢোকার এটাই প্রধান পথ। সকালটায় খুব সরগরম থাকে মাঝির ঘাট। বেলা একটু চাগিয়ে উঠলে মাঝির ঘাটে মনুষ্যসমাগম কমতে থাকে। ঠিক ওই সময় সরলাবালা মাঝিরঘাটে আসে। ঘাটের একপাশে, যেখানে রোদ-হাওয়ায় কাদা শক্ত হয়ে গেছে, ঠিক ওখানটায় এসে দাঁড়ায় সরলাবালা। মাথায় অাঁচলটা তুলে দিয়ে যেদিকে নদী-সমুদ্র মিশে এক হয়ে গেছে, আপনি তো জানেন _ওই দিকেই কয়লার ডিপু, সেদিকে তাকিয়ে থাকে সরলা। একরাতে, আজ থেকে বহু দিন আগের এক গহীন রাতে, ওই দিকেই তো জগৎহরি নৌকা ভাসিয়েছিল। সরলাবালা বিশ্বাস করে এবং সেই বিশ্বাস অনড়, একদিন জগৎহরি ফিরে আসবে; দূরবিসত্মারী ওই নদীপথ দিয়েই ফিরবে জগৎহরি। না ফিরে জগৎহরির কোন উপায় নেই। তাকে ফিরতেই হবে এ কারণে যে, জগৎহরি সেদিন কথা দিয়েছিল যে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। আসতে একটু দেরি হচ্ছে হয়ত, তবে ফিরবে যে এটা নিশ্চিত। কারণ জগৎহরি তো জানে _ এই জগতে জগৎহরি ছাড়া সরলাবালা আর নরহরির কেউ নেই। তাদের দেখাশোনার, তাদের খাওয়ানো দাওয়ানোর কেউ নেই এই সংসারে। জগৎহরি এত অবিবেচক নয় যে, স্ত্রী-পুত্রকে অসহায় অবস্থায় ফেলে দিব্যি লুকিয়ে থাকবে। হয়ত দূরে কোথাও ভেসে গেছে জগৎহরি অথবা কোন কারণে অভিমান করে কিছুদিনের জন্য ভুলে আছে। তার অভিমান ভাঙলে একদিন না একরাত জগৎহরি ফিরে আসবেই এই মাঝিরঘাটে। ঘাটে এসে যদি জগৎহরি দেখে এই রোদজ্বলা দুপুরে বা নদী চুবানো বৃষ্টিতে অথবা কনকনে শীতে সকালে বা দুপুরে বা সন্ধেয় তার বউটি মাথায় আধো ঘোমটা তুলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে, তাহলে কী ভালই না লাগবে জগৎহরির। স্বামীকে এই ভাললাগাটা পাইয়ে দেয়ার জন্য জগৎহরির বউটি সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে বা রোদে ভিজে মাঝিরঘাটের ওই নির্দিষ্ট স্থানে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে।
কত কত মানুষ আসে, কত মাঝি নৌকা ভিড়ায় মাঝিরঘাটে কিন্তু জগৎহরির নৌকাটি আর ঘাটে ভেড়ে না। তাতে কী? আজ না হোক কাল, কাল না হোক পরশু, পরশু না হোক আগামী সপ্তাহে বা মাসে অথবা বছরে জগৎহরি তার পালতোলা নৌকাটি ঘাটে ভিড়াবেই।
এইভাবে এক দুই তিন বছর করে করে চৌত্রিশ বছর কেটে গেল। জগৎহরির নৌকাটি আর ঘাটে ভিড়ল না। ঘাটের কোলে দাঁড়িয়ে সরলাবালার তাকিয়ে থাকাও বন্ধ হলো না।

ধুর মশাই! এভাবে চৌত্রিশ বছর কেউ অপেক্ষা করে নাকি? করে করে। বিশ্বাস হচ্ছে না? আপনি আজই, এখনই মাঝিরঘাটে যান, দেখবেন_একজন আলুথালু মহিলা, মাথায় এক বোঝা উসকো-খুসকো চুল, গায়েগতরে খড়িকাটা দাগ, ময়লা রঙচটা কাপড় পরে সেই আধা-শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় অাঁচল তোলার কথা বলছেন? না, সরলাবালা এখন আর মাথায় অাঁচল তুলে দেয় না। মাথায় অাঁচল তুলে আব্রম্ন রক্ষা করার মতো মানসিকতা এখন তার আর নেই। এক লহমা দেখলে আপনার তাকে পাগলি বলেই মনে হবে। আপনি কেন? আশপাশের মানুষজনকে জিজ্ঞেস করেন, তারাও বলবে, ও_, সরলাপাগলির কথা বলছেন? হঁ্যা, হঁ্যা, ওই তো সরলাপাগলি। ও-ই, ওই যে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে, হঁ্যা ঠিক ধরেছেন_মাঝে মধ্যে দুই হাতের তালু দিয়ে চোখ ডলছে যে মহিলাটি, সে-ই সরলাবালা। শুনেছি এক সময় নাকি মাথাটাথা ভাল ছিল। জগৎহরি না কৃষ্ণহরি নামের একজনের স্ত্রী ছিল সে। বয়সীরা বলে_শ্যামলা হলেও তার মধ্যে নাকি এক সময় এক ধরনের শ্রীময়তা ছিল। কঠিন শব্দটি শুনে চমকে উঠলেন? এই শ্রীময়তা শব্দটি আমার না। আমাদের এই নুনের গোলায় মির্জা আলী নামের একজন লোক ছিল। নরসিংদীর দিকে বাড়ি ছিল তার। এখন বুড়ো হয়ে গেছে বলে বাড়ি ফিরে গেছে। তো তার মুখেই শুনেছি এই শ্রীময়তা শব্দটি। বাড়ি ফিরে যাবার আগে একদিন ওই পাগলামতন মহিলাটিকে দেখিয়ে বলেছিল, 'জানস আশরাফ, ওই যে মহিলাটিকে দেখতাছস, ও কিন্তু এ রকম পাগলাটে ছিল না। এই রকম ময়লা জামাকাপড়ও পরত না সে, বড় শ্রীময় ছিল মেয়েটি। আমার চোখের সামনেই সুস্থ শ্রীময় মাথায় অাঁচলতোলা বউটি পাগলাটে হয়ে গেল। বড় কষ্ট লাগেরে তার জইন্য। স্বামীর জইন্য একটা বউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে করে এতটি বছর কাটিয়ে দিল, ভাবতেই অবাক লাগেরে আশরাফ !'
নরহরির যখন পঁচিশ-ছাবি্বশ বছর বয়স, তখন পড়শিরা বলল_নরহরিকে তো বিয়ে করানো দরকার। মা পাগল, সব সময় হুঁস-জ্ঞান থাকে না। ছেলেটাও খেয়ে না খেয়ে মাকে নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। আমাদের তো একটা কর্তব্য আছে? তো একদিন সবাই মিলে জগৎহরিদের বাড়িতে এল। সেদিন সরলাবালার মাথাটা পরিষ্কার। সকালে উঠে পাশের পুকুরে স্নান করে রোদের দিকে পিঠ দিয়ে নড়বড়ে একটা জলচৌকিতে বসে ছিল সরলা। পড়শিদের কথা শুনে চোখ দুটো ঝলমল করে উঠল তার। ঘোর বর্ষায় আলকাতরা মেঘ সূর্যের সামনে থেকে একটুক্ষণের মধ্যে সরে গেলে চারদিক যেমন ঝলকিত হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি একটি নিবিড় আনন্দ-আলো কিছু সময়ের জন্য সরলার মুখটিকে আলোকিত করে রাখল। মিষ্টি হেসে সরলা বলল, 'অাঁই কি কইতাম? অাঁত্তোন তো কোনো টিঁয়া-পইসা নাই। তোঁ-রা যিয়ান বুঝ, হিয়ান কর।'
পড়শিরা বাঁশবাড়িয়ার সর্বানন্দের মেয়েকে খুঁজে বার করল। সর্বানন্দের স্ত্রী প্রথমে রাজি হয়নি। মা পাগলা স্বভাবের_এই অজুহাত তুলে গাঁইগুঁই করতে লাগল। কিন্তু সর্বানন্দের এককথা_নরহরির সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দেবে। বাপ স্বাধীনতার যোদ্ধা। জগৎহরির হাতে অস্ত্র ছিল না_তাতে কী হয়েছে? মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছে তাদেরকে সহযোগিতা তো করেছে? জগৎহরি তো মুক্তিযোদ্ধাই। তার ছেলেকে মেয়ে বিয়ে না দিয়ে কাকে দেবে? বউকে উদ্দেশ্য করে বলেছে, 'বেশি ত্যারিম্যারি নো গরিস। মাইয়া যেএন তোর, হেএন অাঁরও। অাঁর কথা হুনি রাখ_উন্মাদিনীরে অাঁই নরহরির লগেই বিয়া দিয়ম।'
শেষ পর্যনত্ম সর্বানন্দের কন্যা উন্মাদিনীর সঙ্গে নরহরির বিয়ে হয়ে গেল মাঘ মাসে। জামাইকে একটা একগাছি নৌকাও উপহার দিল সর্বানন্দ বহদ্দার। উন্মাদিনী এসে সংসারের হাল ধরল। নরহরি কর্ণফুলী-বঙ্গোপসাগরে নৌকা ভাসাল। উন্মাদিনী বাচ্চা বিয়াল। আর সরলাবালা জগৎহরির জন্য যথা-অভ্যাসে মাঝিরঘাটে অপেক্ষা করতে থাকল তার আধা-পাগলা মন নিয়ে।

২.
'আরে মশাই, কেমন আছেন? দীর্ঘ চার-পাঁচ বছর পর আপনার সঙ্গে দেখা। তো কোথায় গিয়েছিলেন? এইরকম ঘামে জবুথবু হয়ে কোথা থেকে ফিরছেন?'
'শ্মশান থেকে আসছি।'
'কে মরল আবার?'
'আপনি চিনেন তাকে।'
'আমি চিনি?'
'হঁ্যা, আপনার অনেক দিনের চেনা, অনত্মত ঊনচলিস্নশ বছরের চেনা সেই সরলাবালাই মরল আজ।'
'আহারে বেচারা। কেমনে মরল?'
'সত্যি বলছেন মশাই_আঃহারে।' এই আঃহারের মধ্যেই সরলাবালার জীবনটা শেষ হলো। নিজের ভেতর একটা সুতীব্র হাহাকার নিয়ে ঊনচলিস্নশটা বছর কাটিয়ে দিল এই নারীটি। মুখে কোন হা-পিত্যেশ নেই, চিৎকার চেঁচামেচি নেই, ক্ষুব্ধ ক্ষোভ প্রকাশ নেই, শুধু দু'চোখে তৃষিত এক চাহনি নিয়ে নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই জীবনটা ফুরিয়ে ফেলল সরলাবালা। শেষের দিকে হাঁটতে পারত না সরলা। দু'পা ফুলে গোদের মতো হয়ে গিয়েছিল। নরহরি লেম্ফ ডাক্তারকে দেখিয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল_ সরলাবালার দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধ করতে হবে। নইলে একদিন তার হাঁটা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। নরহরি-উন্মাদিনী অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু সরলাবালার মাঝিরঘাটে যাওয়া বন্ধ হয়নি। যথা সময়ে থপ থপ পা ফেলে ফেলে নদীপাড়ে গেছে সরলা। শেষের দিকে লেন্ডাইয়া সরলাকে ঘিরে-বেড়ে রাখত। লেন্ডাইয়া তখন প্যান্ট পরা অভ্যেস করেছে। বুড়িদি যেদিকে গেছে, লেন্ডাইয়া সরলাকে বুড়িদি বলত, সেদিকেই সঙ্গে সঙ্গে গেছে লেন্ডাইয়া।
আপনাকে এটা তো বলাইবাহুল্য, সরলা যাওয়ার একটাই দিক, একটাই স্থান। সেটা _নদীর দিক, মাঝিরঘাট। চোখে ছানি নিয়ে, নোংরা ময়লা হাত-পা নিয়ে, লম্বা লম্বা নখ নিয়ে, জট বাঁধা এক মাথা চুল নিয়ে খালি পায়ে সকালে_সন্ধেয় বার বার গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে সরলা ওই মাঝিরঘাটে। শেষের দিকে তার চোখের জ্যোতি ফুরিয়ে এসেছিল। দু'চোখের কোণা পিঁচুটিতে ভর্তি হয়ে থাকত। তারপরও ছানি-পড়া চোখ মেলে তার প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে থাকত। আমরা জানি_তার চোখ দুটো নদীজলের কিনারা পর্যনত্ম দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। তারপরও চোখ দুটো তার ক্ষণিক সময়ের জন্যও নিমীলিত হতো না। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এলে তার কান সজাগ হয়ে উঠেছিল। ঘাটে কোন নৌকা ভিড়ার আওয়াজ পেলে সে লেন্ডাইয়াকে বলত, 'চাইয়া দেখত ভাই, তোর দাদু আইল নাকি? ওহো, তোর দাদুরে তো তুই চিনতি নো। তুই তো কোনোদিন তাইনেরে দেখস নো। তই হুন, তোর দাদু দেখতে কিন্তুক রাজপুত্রের মতো। বেশি লম্বা না। ধবধবে ফর্সা। মাথায় কিন্তুক লম্বা চুল। বাবরি চুল। ভাল করি ঠাহর করে চা_ মাঝখানে সিঁথিকাটা। দেইখছস নি?'
'হ বুড়িদি, দেখ্খি। হেই রইম্যা কোন মাঝি তো ঘাঁটত নো দেখির। কালা মোটাইয়া মাঝি উগ্গা এ-না নৌকাত্তোন নামের। হিবা নি কোনো?' লেন্ডাইয়ার কণ্ঠে মর্মঘাতী কৌতুকের সুর।
'ধুর লক্ষ্মীছাড়া দেওতাছাড়া! নরহরির বাপ কালা অইতো যাইবো কিয়লস্নাই? কার্তিক ঠাউরর মতো। ভালা গরি হুন_নাকের নিচে চিঅন এক্খান মোচ আছে। ভালা গরি রেনি চা, রেনি চাই অাঁরে ক, তোর দাদুর নৌকা কূলত্ ভিড়ছে নি?' সেদিন কেন জানি সরলার কণ্ঠ অষ্টাদশী তরম্নণীর মতো উছলে উঠেছিল।
লেন্ডাইয়া চুপ মেরে যায়। ঠাকুরদির এত আবেগের জবাব তার জানা নেই। পাড়ার সকল মানুষের মতো, ঘাটের নিত্যযাত্রীদের মতো, নুন-গুদামের কুলি-কামিনদের মতো এই কিশোরটিও জানে_তার দাদু, ঠাকুরদি জগৎহরি আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। কিন্তু কেমন করে সে ঠাকুরদিকে এ কথা বিশ্বাস করাবে? বললে তো আর ঠাকুরদি বিশ্বাস করবে না। জোর করে বলতে গেলে হয়ত টপাস করে চড় বসিয়ে দেবে গালে। তার চেয়ে চুপ থাকা ভাল। চুপই থাকল লেন্ডাইয়া। কিন্তু বুড়িদি তাকে চুপ থাকতে দিল না। ডান হাতে একটা জোর হেঁচকা মেরে বলল, 'কীরে লেন্ডাইয়া, কিছু কস না কিয়লস্নাই? তোর দাদু আইছে নি? ঘাটের দিকে রেনি চাইছস নি?'
বেমক্কা হেঁচকা টান খেয়ে লেন্ডাইয়ার মাথা হঠাৎ গরম হয়ে উঠল। বলল, 'কইলাম নো- বুড়ি, নো- আইয়ে। তোঁয়ার জগৎহরি আর আইতো নো, কোনোদিন আইতো নো। তোঁয়ার নরহরির বাপ মরি গেইয়ে, খান অলে মারি ফেইল্যে। নদীত্ ভাসি গেইয়ে। হাঙরে কুমিরে খাইয়ে।'
লেন্ডাইয়ার কথা শুনে সরলাবালা কিছুই বলল না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে লেন্ডাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল। মাটির ঘরের দেয়ালে বানের পানি লাগলে যেমন করে ঘরটা চালাসমেত হুড়মুড় করে বসে পড়ে, ঠিক তেমনি করেই আধো-কাদায় বসে পড়ল সরলাবালা। লেন্ডাইয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই বসা থেকে সামনের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সরলা। নদীর দিকে উপুড় হয়ে প্রণাম করার ভঙ্গিতে সরলা পড়ে থাকল। আশপাশের মানুষরা এল, নরহরি-উন্মাদিনী এল, পাড়াপড়শিরা এল। সবাই দেখল_সরলাবালা কাকে যেন উপুড় হয়ে প্রণাম করছে।

তাকিয়ে আছেন যে আমার দিকে? শুনছেন আমার কথা? আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন না কাকে পুড়িয়ে এলাম শ্মশানে? সরলাবালাকেই বলুয়ার দীঘির শ্মশানে পুড়িয়ে এই ভরদুপুরে বাসায় ফিরছি।

আচ্ছা_, যাই ভাই। বহুক্ষণ আপনাকে আটকে রাখলাম। যদি পারেন এই দুখিনী জেলেনীটির কথা মাঝে মধ্যে স্মরণ করেন। আর যদি স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন_তাঁকে আপনার প্রয়োজনের কথা বলা শেষ হলে, সরলাবালার কথা একটু বলবেন। কী বলবেন? বলবেন_অনত্মত স্বর্গে হলেও সরলা যাতে জগৎহরির সাক্ষাত পায়।

Post a Comment

0 Comments