Ticker

6/recent/ticker-posts

চিলেকোঠার সেপাই ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান


চিলেকোঠার সেপাই
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান
জাকির তালুকদার
ঊনসত্তরে জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদের ব্যাপারটা থাকলেও শ্রেণীর ব্যাপারটা কিন্তু ক্রমেই বড় হয়ে উঠছিল। আওয়ামী লীগ এই শ্রেণীর ব্যাপারটাকে চাপা দিল বাঙালিত্বের ধুয়া তুলে। মুজিব জেল থেকে এসে প্রথমেই বললেন, 'আপনারা শান্ত হোন।' বললেন, 'আমরা সবাই বাঙালি।' চবড়ঢ়ষব যেভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল তাতে ভয় পেয়েছিলেন তাঁরা। আমার মনে আছে, রেকসে একদিন আড্ডা দিচ্ছিলাম, আমাদের পাশের টেবিলে এসে বসলেন খন্দকার মোশতাক। বাইরে তখন প্রচণ্ড মিছিল-মিটিং। মোশতাক খুব খেপে গিয়ে বলেছিলেন, 'এত রিষফ হওয়ার কোনো মানে হয়? এই রিষফ যড়ধৎংব-কে এখন কে সামলাবে?' এটাই হলো ঃুঢ়রপধষ বুর্জোয়া ঢ়ড়ষরঃরপং-এর কথা।
তারপর শেখ মুজিব যেদিন ৭ মার্চের বক্তৃৃতা দিয়ে ফিরছেন, আমি ওই শাহবাগের মোড়ে ভিড়ের ঠেলাঠেলিতে কিভাবে যেন শেখ মুজিবের গাড়ির একেবারে কাছে গিয়ে পেঁৗছেছিলাম, একেবারে মুজিবের গাড়ির জানালার পাশে। মুজিব জানালা দিয়ে ঢ়বড়ঢ়ষব-কে দেখছেন। সেদিন তাঁর চোখে আমি দেখেছিলাম ভয়, হড়ঃযরহম নঁঃ ভবধৎ। ভাবছেন বোধহয় এ লোকগুলোকে তিনি কোথায় নিয়ে যাবেন? কোনো ঢ়ষধহ তো তাঁর ছিল না। আর মানুষ তো তখন শুধু পাকিস্তান থেকেই মুক্ত হতে চায়নি, আরো অনেক কিছু চেয়েছিল।
[স্বকণ্ঠ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস]
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ওপর যেসব ইতিহাসগ্রন্থ লিখিত হয়েছে, সেগুলোতে হয়তো নির্ভুল তথ্য রয়েছে, কিন্তু সেগুলো পাঠ করে কেউ সেই দিনগুলোর উত্তাল মুহূর্তগুলোকে অনুভব করতে পারবেন না। কারণ লিখিত বিবরণ কোনো দিনই রক্তের দানায় দানায় ছড়িয়ে থাকা উত্তেজনা, উত্তাপ, আকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভ, গ্লানি এবং আনন্দকে তুলে আনতে পারে না। বিশেষ করে প্রবন্ধ বা দলিল। তাই বলে দলিলের কোনো উপযোগিতা নেই, এমন কথা মূর্খ ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। কিন্তু আমরা ইতিহাসগ্রন্থ আকারে যেসব দলিল হাতে পেয়েছি, সেগুলোতে সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ইলিয়াসকথিত মানুষের 'আরো অনেক কিছু' চাওয়ার বিষয়টিকে। এ ব্যাপারটিকে ধরতে পেরেছিলেন ইলিয়াস, এই শূন্যতা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছিলেন_খুঁজছিলেন এমন একটি গ্রন্থ, যেখানে ঊনসত্তরে মানুষের আত্মদানের এবং আকাঙ্ক্ষার সঠিক মাত্রাগুলো উপস্থাপিত হয়েছে। পাননি। পাননি বলে নিজেকেই লিখতে হলো তাঁর। আর ঔপন্যাসিকের কলমে এবং উপন্যাসের আঙ্গিকে বেরিয়ে এল বাঙালির ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আন্দোলনের হৃদস্পন্দন_চিলেকোঠার সেপাই।
উপন্যাসের শুরুতে পাওয়া যায় ওসমানের দেখা। শেষেও ওসমান। উপন্যাসে সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করে আছে যে চরিত্র, সে ওসমান। অথচ এই উপন্যাসের মূল ঘটনাপঞ্জির সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা সবচেয়ে কম। সে শুধু দেখে যায়। দেখেই যায়। পর্যবেক্ষণও করে না। কারণ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পর্যালোচনা। গণ-আন্দোলন বা প্রায় ঘটতে যাওয়া গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে কোনো পর্যালোচনা তাকে করতে দেখা যায়নি উপন্যাসের কোথাও। পুরান ঢাকায় আইয়ুব খানের অনুসারী মহাজন রহমতউল্লার বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠার একমাত্র ঘরে তার বসবাস। সেখান থেকে সে দেখতে পায় বেবিট্যাঙ্,ি রিকশা, নারায়ণগঞ্জগামী বাসের পাশাপাশি হেঁটে চলা মানুষের ভিড় ও মিছিল। অফিসে যাওয়ার পথে বাহাদুর শাহ পার্কে জনসভা দেখে। পল্টনেও জনসভা দেখে। রেস্টুরেন্টে বসে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় বন্ধুদের কাছে শোনে আন্দোলন-সংগ্রামের কথা। কিন্তু নিজে থাকে ফেলে আসা বাপের চিন্তায়, এই বাড়ির দোতলার ভাড়াটের মেয়ে রানুর চিন্তায়, অন্য বন্ধুদের চিন্তায়। এমনও নয় যে সে সারা দেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি নিয়ে চিন্তিত নয়। বরং উল্টো। চিন্তা সে অনেক করে। চিন্তা না করে উপায় নেই। কারণ এমন প্রচণ্ড ঘটনাবলি ঢাকা তো বটেই, পূর্ববঙ্গের সব অস্তিত্ববান সত্তাকেই নাড়া খেতে বাধ্য করছে। সারা দিন তো বটে, রাতেও কোনো বিরাম নেই ঘটনা ঘটার। সে কারণে এমনকি ১০০ বছরেরও আগে বিদ্রোহী সিপাহিদের ফাঁসি দেওয়ার জন্য নবাব আবদুল গনিকে দিয়ে পোঁতানো পামগাছ বা সেসব পামগাছের বাচ্চারা মানুষের স্লোগানে ভালোভাবে ঘুমাতে পারে না। ফলে ওসমানের ঘুমও কমে যায়। ঘুমের বদলে সে জেগে জেগে দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকে। ধীরে ধীরে সেই স্বপ্ন আবার বেশির ভাগই পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে।
এই আন্দোলনের গন্তব্য কোনটা? এমন প্রশ্নও কেউ কেউ করে। আইয়ুব খান তথা পাকিস্তানিদের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা এতটাই যে হোটেলের দেয়ালে আইয়ুব খানের ছবি ঝুলতে দেখলে মিছিলের মানুষ এসে সেই ছবি গুঁড়িয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু এ ঘৃণা মানুষকে কি এনে দেবে? নিছক আইয়ুব খানের অপসারণ? স্বায়ত্তশাসন? ছয় দফা? স্বাধীনতা? কিন্তু মানুষের আকাঙ্ক্ষা তো আরো বেশি। সেই আকাঙ্ক্ষা আনোয়ারের প্রশ্নের মাধ্যমে উঠে আসে_'ভাষা, কালচার, চাকরি-বাকরিতে সমান অধিকার, আর্মিতে মেজর জেনারেলের পদ পাওয়া_এসব ভদ্রলোকের প্রবলেম। এই ইস্যুতে ভোটের রাইট পাওয়ার জন্য মানুষের এত বড় আপসার্জ হতে পারে?'
সাধারণ মানুষ এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর না জেনেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে আন্দোলনে। সেই সাধারণ মানুষের জলজ্যান্ত প্রতিনিধি হাড্ডি খিজির। শহরে খিজিররা যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, গ্রামে-গ্রামে সেভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে চেংটু, করমালি, আলী বঙ্রা। তাদের কর্মসূচি আরো বেশি অগ্রসর। তারা অনেক দূরের আইয়ুব খান, পাকিস্তানি বাহিনী, পিণ্ডির শোষণ যেমন দেখতে পায়, চোখের কাছে খয়বার গাজী, আফসার গাজীদের ভূমিকাও তেমন স্পষ্টভাবেই চিনতে শেখে। জানতে পারে যে খয়বার গাজীরাই হচ্ছে সেই সব মানুষ, যারা আইয়ুব খানদের আঞ্চলিক প্রতিনিধি। আইয়ুব খানরা যদি বিশালদেহী দিগন্তবিস্তারী জোঁক হয়, সেই জোঁকের মুখ হচ্ছে খয়বার গাজীদের মতো লোকরা। তারা সেই জোঁকের মুখে লবণ দেওয়ার কাজটাও করতে চায়। কিন্তু তাতে সমর্থন নেই আইয়ুববিরোধী ছয় দফার প্রবক্তা-নেতাদের। কারণ, তারাও খয়বার গাজীদেরই শ্রেণী-উত্তরসূরি। কী করে খয়বার গাজীরা? তারা মানুষের নামে অহেতুক মামলা ঠোকে, ভিটেমাটি কেড়ে নেয়, কেউ প্রতিবাদ করলে তার লাশ পাওয়া যায় মাঠে-নদীতে, এমনকি হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে নিজের অবাধ্য কিষানকে পর্যন্ত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পুড়িয়ে মারতে পারে। আদালতের মামলায় কোনো দিন খয়বার গাজীরা শাস্তি পায় না, মামলায় হারে না। কারণ, সরকারের আদালত তো তাদেরই আদালত। তাই আলী বঙ্রা, খয়বার গাজীরা গণ-আদালত বসাতে চায়। সেখানে বিচার করতে চায় খয়বার গাজীর মতো মানুষদের। বিচার করতে চাওয়ার কথা আসছে এত বছর পরে, কারণ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মানুষ প্রস্তুত হয়েছে। যমুনা নদীতে ঘোড়ার ডাক শোনা যাচ্ছে। 'বড় ধরনের বালা-মুসিবত, সংকট, বিপদ-আপদ, দুর্যোগ, বিপর্যয় সামনে থাকলে যমুনার মধ্যে দেড় শ দুই শ ঘোড়া সংকেত দেয়।' সেই ফকির মজনু শাহের সময় থেকে দিয়ে আসছে। এবারের মুসিবত খয়বার গাজীদের। ডাকাত-মারা চরের বাথান তার লুট হয়, তার প্রধান অনুচর হোসেন আলী নিহত হয় বিক্ষুব্ধ মানুষের হাতে। এখন গণ-আদালতে বিচার হবে তার। গ্রামের সংগঠিত মানুষ প্রত্যয়ের সঙ্গে ঘোষণা করে, 'এইবার বুঝবি মানুষের হাতে মরতে কেমন লাগে। বেটা এখান থেকে কলকাঠি নাড়ো, মানুষের গরু চুরি করে তার কাছ থেকেই জরিমানা আদায় করো। কারো জমিতে তারা বর্গা দিতে না পারে সেই ফন্দি আঁটো? সবাই এসে তোমার পায়ে পড়ুক, তুমি ইচ্ছামতো মানুষের ভিটাটুকু পর্যন্ত কবজা করে তাকে তোমার গোলাম বানাও!_এইবার? এইবার ভেতর থেকে ভাঙতে শুরু করেছে, ওপরটা আপনাআপনিই ধসে পড়তে কতক্ষণ?
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের আসল চেহারা তো এইখানে, এ বৈরাগীর ভিটায়। মানুষ ভেঙে পড়েছে সেখানে। ভিড় দেখে মনে হবে, 'গোটিয়া, তালপোতা, পদুমশহর, চিথুলিয়া, উত্তরের চন্দনদহ, দরগাতলা, কর্নিবাড়ী, পশ্চিমের কড়িতলা, দরগাতলা, কামালপুর, গোলাবাড়ী_কোনো গ্রামে পুরুষ মানুষ আজ ঘরে নেই।' সেখানে গণ-আদালত বসেছে। সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে খয়বার গাজীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবারের রাতে বিচার বসেছে। সে সবার কাছে সময় চায়। আগামীকাল শুক্রবার জীবনের শেষ জুমার নামাজটি আদায় করার পর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হোক। আনোয়ার বোঝে সে সময় চেয়ে নিচ্ছে। সময় পেলে ফাঁদ কেটে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে, সুযোগ বের করে নেবে ঠিকই। কিন্তু ওই জুমার নামাজের বাসনা! মুহূর্তের মধ্যেই ভিজে যায় মানুষের মন। আহা তার জীবনের শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করতে দেওয়া হোক। আলী বঙ্ ব্যাপারটা বোঝাতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। মানুষ খয়বার গাজীর মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারেও যেমন একমত, তেমনই তাকে শেষবারের মতো জুমার নামাজ পড়ার সুযোগদানের ব্যাপারেও একমত। ফলাফল_খয়বার গাজীর পালিয়ে যাওয়া। নিজের লোকদের গুছিয়ে নেওয়া, প্রশাসনের সাহায্যে আলী বঙ্কে এলাকাছাড়া করা এবং চেংটুর মৃত্যু। তার পরই দেখা যায়, মানুষ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে গেছে। বিরোধী দলের নেতা হয়েছে খয়বার গাজীর লম্পট-মদারু ভাতিজা আফসার গাজী। ক্ষমতার বলয় সেই সব আগের শ্রেণীর মানুষের হাতেই।
তবে নিজেকেসহ সবাইকে আবারও মনে করিয়ে দিই যে 'চিলেকোঠার সেপাই' ইতিহাস নয়_উপন্যাস। বাংলা ভাষার গুটিকয় সফল উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম একটি উপন্যাস। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাসের জন্য আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় সেই 'চিলেকোঠার সেপাই'-এর। কারণ? ওই যে অ্যাঙ্গেলস বলেছিলেন, ম্যাকবেথ নাটকের মধ্যে ওই সময়ের চালচিত্র যত নিখুঁতভাবে পাওয়া যায়, সব ইংরেজ ইতিহাসবিদের সব পুস্তক একত্র করলেও সেটা পাওয়া যাবে না।
এখানেই তো সত্যিকারের সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্ব।


নতুন বই ইমেইলে পেতে হলে

Post a Comment

0 Comments